Twin Falls – ভ্রমণ দুনিয়ার আরেক মুকুটের পালক:
এ কথা বলতে আমার আর এখন কোনো দ্বিধা নেই যে – Yellowstone ও Grand Teton পাহাড় ও তার চারপাশের গ্রাম ঘুরে যে বিস্ময় ও উত্তেজনার মুহূর্ত অনুভব করেছি, তার একটা বিশেষ ভাবে যেন শেষ হয় ! ঠিক এইরকম একটা আব্দারের সঙ্গে-সঙ্গে আমরা Twin-Falls এর দিকে এগিয়ে চলেছিলাম ! এখন আর বলতে বাধা নেই যে, ওই স্থান আমাদের হতাশ করেনি ! এক অর্থে আমাদের ঘুরতে যাওয়ার এর তৃতীয় রত্ন হিসাবে স্থান পেয়েছে !

সেই পরিকল্পনা মতো, আমাদের Grand Teton পাহাড় ও তার চারপাশের গ্রাম গুলো দেখে স্থানীয় সময়ে বিকেল 4 টায় আমরা রওয়ানা দিলাম ! কয়েকজন স্থানীয় লোক আমাদের বলেছিলেন যে, এই পাহাড় রাস্তা খুব ই দুর্গম, আঁকা-বাঁকা ! অনেক জায়গায় রাস্তার ধারে কোনো পাঁচিল ও নেই ! তার থেকেও বড়, পাহাড় এর ওপর জঙ্গল এ সূর্যের আলো ঠিক করে প্রবেশ করেনা ! তাই, আমাদের উচিত আলো থাকতে-থাকতেই পাহাড় টপকে অন্য রাজ্যে প্রবেশ করে যাওয়া ! কারণটা, কিছুক্ষন যাওয়ার পরেই বুঝতে পারলাম ! শুনেছি, কোনো কোনো জায়গায় রাস্তা প্রায় দশ হাজার ফিট এর ও বেশি ! তার, একদিক এ পাহাড়, আর অন্য দিক এ গভীর খাদ ! সুতরাং, অন্য দিক নিয়ে বেশি নাভাবাই ভালো ! অনেক জায়গায় রাস্তা এতটাই আঁকা-বাঁকা, যে ইন্দ্রনীল দা, গাড়ির গতি 30 মাইল এর বেশি তুলতেই পারছিলো না ! এ এক অদ্ভুত ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ! এখন অবশ্য বাড়িতে বসে লিখতে বেশ ভালোই লাগছে, তখন প্রতিটা মুহূর্তে বুক এর ভেতর ঢিপ-ঢিপ করে হৃৎপিন্ডের শব্দ শুনতে পারছিলাম ! প্রায় 3 ঘন্টা পরে আমরা আইডাহো বলে আরেকটি রাজ্যে প্রবেশ করার সঙ্গে-সঙ্গেই সমান্তরাল কৃষি জমি দেখতে পেলাম ! তার সঙ্গে আমরা আমাদের এখানে আসার সেই লম্বা হাইওয়ে তে পড়লাম ! এর দুদিক এ শুধুই মাঠ ! মাঝখান দিয়ে আমাদের একমাত্র গাড়িটা এবারে দুর্দান্ত গতিতে ছুটে চলেছে ! এই দৃশ্য টা দেখে, আমার “সোনার কেল্লা” এর সেই বিখ্যাত দৃশ্য মনে পরে গেলো – যেখানে ফেলুদা ও তার দলবল রাজস্থানের রাস্তায় দুর্দান্ত গতিতে দুস্টু লোকেদের পিছু ধাওয়া করেছিল ! বাঙালি বলেই মনে হয়, এমন ভাবে ঘুরতে যাওয়াকে উপভোগ করতে পারি আমরা ! অবশেষে, স্থানীয় সময়ে রাত 9 টায় আমরা হোটেল এ ঢুকলাম !

এই যাওয়ার পথে যদি টুকটাক মুখে কিছু নাই চলে, তাহলে আর বাঙালি হিসাবে ঘুরতে যাওয়ার সার্থকতা কোথায়? আর, তাছাড়া এতক্ষনে তো আপনারা বুঝেই গেছেন যে আমি ও ইন্দ্রনীল দা, দুজনেই খুব ই ভোজন রসিক ! তাই, চট করে আমার বাড়ি থেকে আনা নতুন টক-ঝাল মটরের প্যাকেট টা বার করা হলো ! সঙ্গে, Yellowstone থেকে আনা কফি যেন আরেক অনবদ্য তাল দিলো ! মেজাজ টা যাতে আরো ভালো করে আসে, চালিয়ে দেওয়া হলো “সোনার কেল্লা” এর অডিও সিডি ! ব্যাস, আর কি চাই ! আমার তো মনে হয়না, ঘোরার সাথে রোমাঞ্চের অনুভূতি এই ভাবে কেও সৃষ্টি করে ঘোরাটাকে আরো কয়েক গুন্ বাড়িয়ে উপভোগ করেছে !

অবশেষে, হোটেল এ পৌছালাম স্থানীয় সময়ে রাত সাড়ে 9 টায় ! হোটেল এর চেক-ইন সেরে নিয়ে, যে যার রুম এ ঢুকে আগে গরম জল দিয়ে স্নান করতেই ক্লান্তি টা একটু দূর হলো ! এবারে, আমি ইন্দ্রনীল দার রুম এ গিয়ে দরজা তে দুটো টোকা দিলাম ! ও এসে দরজা খুলে দিলো ! এই, হোটেল টা বেশ ভালো ! তার থেকেও যেটা বড়ো হলো, প্রায় – প্রত্যেকটা ঘরে একটা করে ছোট্ট ডাইনিং টেবিল আছে ! যাতে আরাম করে জনা 4-এক বসে খাওয়াদাওয়া করতে পারে ! তাই, ইদ্রানীল দা, এইবারে রুম এই খাবারটা আন্তে বলে দিলো ফোন করে ! খাওয়াদাওয়া সেরে আমি আমার ঘরে চলে এলাম ! এরপর, জিনিস পত্র খানিকটা প্যাক করে, আবার শুয়ে পড়লাম !

খাবার টেবিল এ ঠিক করা হলো, হোটেল এর কাছেই নামকরা একটা ব্রিজ আছে ! সেটা দেখে নিয়ে তারপর Twin-Falls টা দেখতে যাবো ! সেই কথা মতো, সকাল সাড়ে 9 টার মধ্যে জলখাবার খেয়ে চেক-আউট করে বেরিয়ে গেলাম !

আমাদের সিদ্ধান্ত টা যে একদম ই ঠিক, সেটা গিয়ে বুঝলাম ! দুটো খুব ই উঁচু মালভুমি কে এই ব্রিজ টা দিয়ে জোড়া হয়েছে ! নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী ! তার থেকেও যেটা আরো বড়, এই ব্রিজ টা দেখতে – অনেকটাই এক পুরোনো বিখ্যাত হলিউড মুভি – “The Bridge on the River Kwai” এর মতো ! এক কথায়, আরো এক অসামান্য স্থান কে সচক্ষে উপভোগ করলাম !

ব্রিজ টাকে ভালো করে দেখার জন্য দুধারেই ব্রিজ এর দিক এ, গাড়ি রাখার বন্দোবস্ত আছে ! সেখান দিয়ে নেমে এসে পাহাড় এর গা কেটে একটা সমান ভূমি করা হয়েছে ! যেটা ঘেরা থাকে জাল দিয়ে ! সেখান থেকে উপত্যকা ও নদীকে অনায়াসেই দেখা যাই ব্রিজ ছাড়াও !

এই জায়গাটায় আসার জন্য, ব্রিজে এর ধার ঘেসে পাহাড় কেটে সিঁড়ি করা হয়েছে ! সেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে এই যায়গাটা উপভোগ করা যাবে !

এও, আরেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা ! নদীতে কয়েকজন তাদের ছোট নৌকা নিয়ে এডভেঞ্চার স্পোর্টস এর অভ্ভাস করছেন ! অনেক ওপর থেকে তাদেরকে দেখলে ঝুলন এর সেই ছোট্ট পুতুল এর মতো লাগে !

আমরা প্রায় আধ ঘন্টা ওখানে কাটিয়ে আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল এর জন্য রওয়ানা হলাম ! এই ব্রিজ থেকেও Twin-Falls এর দূরত্ব খুব বেশি নয় ! গেট এর সামনে পৌঁছে রাস্তাটা খুব ই সরু আঁকা-বাঁকা হয়ে নিচে প্রায় 500 ফিট নেমে গেছে ! রাস্তা এতটাই সরু, যে পাশাপাশি দুটো গাড়ি ঠিক করে যেতে পারবে কোনোমতে ! তার থেকেও যেটা বড় হলো, এখানেও রাস্তার ধারে কোনো পাঁচিল নেই ! গাড়ি, খুব ধীরে নিচে নামলো ! গাড়ি একটু দূরে নিচে নেমে পার্ক করে হেঠে যেতে হলো ! এর মধ্যে আমরা ঝর্ণার শব্দ শুনতে পারছি ! যত কাছে এগিয়ে চলেছি, ততই বেড়ে চলেছে সেই শব্দ ! এরপরে, আমরা লক্ষ্য করলাম একটা কাঠের সরু পাটাতন ! তার ওপর দিয়ে হেঠে গিয়ে একটা দাঁড়ানোর জায়গা ! যেটা, পাহাড় এর গা থেকে খানিকটা বেরিয়ে এসে ঝুলে, পাহাড় এর সঙ্গে আটকে আছে ! এটা করা হয়েছে, যাতে পাহাড় কোনোভাবে ঝর্ণা কে দেখতে বাধা না দেয় !

এক সঙ্গে দুটো ঝর্ণা এর শব্দ, তার মধ্যে সেই জল থেকে বেরিয়ে আসা জলকণা থেকে তৈরী রামধনু ! এ যেন – মেঘ না চাইতেই জল ! এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা ! সত্যি, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না !

এখনো যখন এই ছবি গুলো নিয়ে ঘাঁটি, মনে হয় যেন সেই সময়ে ফিরে গেছি ! এ এক বিস্ময়কর ঘুরতে যাওয়ার গল্প, যার প্রায় প্রতিটি মোরোকেই রয়েছে তাজ্জব সব ঘটনা !

এমন কি গাড়ি পার্কিং এর জায়গাটিও ভীষণ সুন্দর ভাবে গাছপালা দিয়ে সাজানো, যা দেখলে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে !

তার মধ্যে ওই খানে তথ্য কেন্দ্র এর সামনে ছোটদের একটা ইনফরমেশন পার্ক আছে, যেখানে ওই ঝর্ণা তার চারপাশের আরো অনেক মজাদার তত্থ দেওয়া আছে, যা কেবল স্থানীয়রা জানেন !

এরপরে, আমরা তথ্যকেন্দ্রতে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়ে, আরো কিছু চিপস, স্যান্ডউইচ, জল ও কিছু কোল্ড-ড্রিঙ্কস কিনে নিলাম ! ফেরার পথে এগুলো কাজে দেবে ! তারপর, আরো একবার আমরা গাড়ির ট্রাঙ্ক এ রাখা সব জিনিস পত্র দেখে নিলাম ! কিছু হোটেল এ থেকে গেলে, এখনো আমরা গিয়ে নিয়ে যেতে পারবো ! অবশেষে, আমরা Twin-Falls থেকে ঘরে ফেরা শুরু করলাম ! আর, মনে-মনে বললাম – “বিদায় Twin-Falls” !

ইন্দ্রনীল দা, গাড়ির ইঞ্জিন কিছুক্ষন স্টার্ট করে রেখে, GPS এ আমার বাড়ির ঠিকানা করে দিলো ! আর, তার সঙ্গে ফেরার মুহূর্ত এর মধ্যে সামান্য মন খারাপের সম্ভাবনা কে আঁচ করে একটা বাঁশি আর সন্তুর এর যুগলবন্দী চালিয়ে দিলো !

সত্যি কথা বলতে কি, এই সময়ে আমার মনের মধ্যে একটা দন্ধ চলছিল ! একদিকে, এই ঘোরার শেষ হওয়ার দুঃখ, অন্যদিকে যেসব ছবি আমি তুলেছি – তা প্রকাশ করার চূড়ান্ত আনন্দ ! যাওয়ার পথে যদি কোনো ভালো মুহূর্ত পাওয়া যায়, সেই ভেবে একখানা ক্যামেরা কে আমি হাথের কাছে রেখে দিলাম !
বলতে বাধা নেই! এবারেও, আমি হতাশ হলাম না ! রেনো শহর ঢোকার আগেই অসাধারণ এক সূর্যাস্তের মুখোমুখি হলাম !

এরপরে, লেক তাহো জঙ্গলে মধ্যে ঢুকে গেলাম ! এই জঙ্গলে খুব বেশি আলো এমনি ঢোকেনা ! সন্ধে বেলায় অনেকটাই অন্ধকার হয়ে যায় ! সেই জঙ্গল পেরোতে লাগলো প্রায় 15 মিনিট ! এরপর, লেক তাহো ছাড়ার ঠিক আগে আরও এক অপূর্ব সূর্যাস্ত দেখলাম ! এবারেরটা, যেন আরো বেশি সুন্দর !

আমাদের প্রায় আরো দু ঘন্টা লেগে গেলো সাক্রামেন্টো বলে শহরটাই পৌঁছাতে ! এটা, ক্যালিফর্নিয়া এর অন্যতম বড় শহর ! সপ্তাহের শেষে, সবাই বাড়ি ফেরার জন্য এতো বেশি গাড়ি রাস্তায় ! তাই, আমি আর ইন্দ্রনীল দা ঠিক করলাম, এখানে রাতের খাবার টা সেরে রওয়ানা হবো ! তাতে, আমাদের একটু বিশ্রাম ও হবে, আর রাস্তাও খানিকটা ফাঁকা থাকবে ! আমি এর আগেও লেক তাহো আসার সময় বিশেষ একটি ভারতীয় রেস্টুরেন্ট এ খেয়েছিলাম ! খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু ! তাই, আমরা দুজনে ঠিক করে “তান্দুরি গ্রিল” হোটেল এর সামনে গাড়ি রেখে প্রবেশ করলাম !

আমাদের মেনুতে ছিল গরম গরম কষা পাঠার মাংস, সঙ্গে নরম বাটার নান, তার সঙ্গে পোলাও ! আর গলা ভেজানোর জন্য এক গ্লাস করে ল্যাস্সি ! ওই খিদের মধ্যে, এতো সুস্বাদু খাবার পেয়ে ইন্দ্রনীল দা, পুরো আত্মহারা ! আমিও মজা নিচ্ছিলাম !

আমাদের খেতে-খেতে প্রায় এক ঘন্টা লেগে গেলো ! তার মধ্যে রাস্তার যানজট অনেকটাই কমে গেলো ! প্রায়, 10 টা নাগাদ আমরা আবার রওয়ানা দিলাম সান রামোন এর দিক এ ! ইন্দ্রনীল দা, আমায় আগে নামিয়ে দিয়ে তারপর ওর বাড়িতে যাবে !

এরপরে, প্রায় দু ঘন্টা যাওয়ার পর অবশেষে আমার শহর সান রামোন এ পৌছালাম !

একথা মানতেই হবে যে শেষ 5 দিনের এই ঘোড়ার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এক নতুন মানে এনে দিয়েছিলো ! বলতে পারো, নিজেকে আবার নতুন করে শুরু করার সব শক্তি ফিরে পেয়েছিলাম ! তার থেকেও বড়ো হলো, এরকম এক অসামান্য রোমাঞ্চের সাক্ষী হতে পেরে ! তাই, আজ আমিও বলতে পারি – “আমি পেরেছি !”, সেই মনের ভিতরের ঘোরার জন্য ছটফটিয়ে ওঠা মানুষটা আবার জেগে উঠেছে !

আমার এই অভিজ্ঞতা আপনাদের কেমন লাগলো তা অবশ্যই জানাবেন ! আমি অপেক্ষায় রইলাম !

আমি আবার একটা এরকম কাহিনী নিয়ে খুব শিগগির হাজির হবো ! ততদিনের জন্য, আপনারা সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন !

Subscribe বোতাম এ ক্লিক করুন আপনার ইমেইল দিয়ে, ও আরো অনেক ছবির সাথে ঘুরতে যাওয়ার গল্প পড়ুন !