যারা আমার নাসার অভিজ্ঞতা পড়েছেন, তারা এতক্ষনে জেনে গেছেন যে ওখানে সব শো দেখে আমাদের ভীষণ খিদে পেয়ে যায় ! সেই কারণে, পাশেই থাকা এক রেসরুরেন্ট এ আমরা বসে খাই ! খেয়ে একটু শক্তি ফিরে এলে আমরা পরের দিনের পরিকল্পনা করে ফেলি বাকি সব মেম্বারদের মতামত নিয়ে !
সেই কথা মতো, পরের দিন সকাল ৮-টার মধ্যে আমরা রওয়ানা হয়ে যাই ! তা নাহলে, আমরা সব কটা শো দেখতে পারবো না ! Sea-World এ আমরা পৌঁছাই সকাল ৯-টার একটু আগে !

এখানেও আমাদের কে গাড়ি বেশ দূরে রেখে হেঠে টিকেট সেন্টার এ পৌঁছাতে হলো ! পৌঁছেই বুঝতে পারলাম যে ভিড়টা নেহাত ই কম নয় ! এরপর, আমরা অনলাইন এর কাটা সব তত্থ দিয়ে একদিনের পাস জোগাড় করে নিলাম !

এর মধ্যে, আমরা বুকলেট দেখে ঠিক করে নিলাম যে কোন কোন শো-গুলো আমরা আগে দেখতে পারি ! তার একটা পেন্সিল দিয়ে ছকে রেখে দেয়া হলো !
এর ই মধ্যে লক্ষ্য করলাম যে, “ভ্যাকেশন এক্সপেরিয়েন্স সেন্টার” ভিড় ক্রমেই বেড়ে চলেছে ! কাজ টা যদিও খুব সহজ হবেনা ! তবু, আমরা সেদিকে আর না ভেবে এগিয়ে চললাম !

আমরা প্রায় দৌড়াতে-দৌড়াতে একটা বড়ো থিয়েটার এ ঢুকে গেলাম ! এখানে শুনলাম কয়েকটা সীল মাছ তাদের খেলা দেখাবে ! এই থিয়েটার এর আদল টা দেখে আমার অনেকটা ইতালি এর এমফিথিয়েটার এর মতো লাগলো ! যদিও, এটা বাইরেটা দেখতে সম্পূর্ণ আলাদা !

আমরা অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম যে এইখানে একটা ডাকাতদের প্রেক্ষাপটে নাটক চলছে, যেখানে এই সিল মাছগুলি তাদের চেনা পরিচিত কৌতুক ঢঙে তাদের পরিচালক মানুষ বন্ধুদের সাথে সমান তালে অভিনয় করে চলেছে ! প্রতিটা দৃশ্য বড়ই টানটান ও মজার, যে ভাবাই যায়না – এরা কি করে মানুষদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক সেইভাবে অবলীলায় অভিনয় করে চলেছে ! তার থেকেও আরো মজার হলো, যখন একজন পরিচালক কিছু দর্শক কে ডেকে নিলেন এই অভিনয়ে যোগদানের জন্য ! এই সময়ে পরিচালক তার মাইক্রোফোন এ সেই দর্শক যা-যা করার কথা বলছেন বা জিজ্ঞাসা করছেন, তার ঠিক পেছনে এই সিল মাছটি নানানরকম মজার অঙ্গভঙ্গি করতে থাকলো !

এই দেখে সারা গ্যালারি জুড়ে হাসির তুফান উঠলেও সেই দর্শক, যিনি যোগদান করেছেন ওই নাটকে – তার পক্ষে বোঝার কোনো উপায় ছিল না ! তিনি, শুধু একটু অবাক হয়ে অল্প-অল্প হেসে বোঝার চেষ্টা করছিলেন ঠিক হচ্ছে টা কি ! নাটকের শেষে তিনটে সিল মাছ ই তাদের নিজেদের পরিচালক এর কাছে গিয়ে এক ভাবে দাঁড়িয়ে সবাই কে নমস্কার জানিয়ে তাদের পুরস্কার এর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো ! পুরস্কার স্বরূপ তাদের অতি পছন্দের কিছু মাছ খেতে দেওয়া হলো !

যদিও এই নাটক টি চল্লিশ মিনিট এর ছিল, কিন্তু আমাদের যেন মনে হলো ভীষণ তাড়ারাড়ি শেষ হয়ে গেলো ! খুব ভালো আর টানটান স্ক্রিপ্ট বলেই এমন মনে হয় !
এরপর, আমরা ছুটে গেলাম “জুরাসিক পার্ক” বলে একটা রাইড চড়তে ! এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, এই রাইড টা করাই হয়েছে এই চলচ্ছিত্রের পরিচালকের সাথে কথা বলে ! তাই সঠিক পর্দার মুহূর্ত গুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে আমাদের চোখের সামনে ! শুরুতেই, একটা স্ক্রিন এ ওই চলচিত্রের ই একটা মুহূর্ত দেখতে পাই, যেখানে বলা হচ্ছে যে একটা ডাইনোসর খাঁচা থেকে কিছু লোককে মেরে পালিয়ে গেছে ! অবশ্য, আমরা ঘুরে চলেছি এমন এক গাড়িতে যা ওই চলচিত্রে ব্যবহার করা গাড়ির আদলের সঙ্গে হুবহু মেলে ! এবং, যতই আমাদের যাওয়া এগিয়ে চলেছে, ততই শুনতে পারছি বন্দুক এর আওয়াজ, গুলি ও আরো অনেক গোলার শব্দ ! হঠাৎ ই শুনতে পেলাম, কিছু মানুষ এর বিকট চিৎকার এর শব্দ ! আমাদের সেই গাড়িতে এখন সত্যি সবাই খুব সজাগ হয়ে আছে ! এর মধ্যে ঘটে গেলো আরো এক কান্ড, ওই চলচিত্রের অভিনেতা ছুটে কাছ থেকে বলে উঠলো – “আপনারা শিগগির পালান ! ও এদিকেই আসছে !” কথাটা, শেষ করার ঠিক আগেই ঝোপে লুকিয়ে থাকা এক রাপ্টার ঝাঁপিয়ে পরে লোকটিকে আক্রমণ করে, ঘায়েল করে তাকে মুখে করে নিয়ে পালালো ! চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখে আমাদের গাড়িতে অনেকেই আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো ! এবং, সেই দৃশ্য দেখে আমাদের গাড়ি তার গতি বাড়িয়ে দিলো ! এর ই মধ্যে গম-গম শব্দে চারিদিক কেঁপে উঠলো ! সেই কম্প যেন গাড়িতে চলা অবস্থায় ও আমরা বুঝতে পারছিলাম ! তারপরেই, আমাদের গাড়ি পরে গেলো ওই চলচিত্রের বিখ্যাত সেই টিরানোসরাস এর খপ্পরে ! সে তীব্র গতিতে আমাদের দিকে ধেয়ে এলো ! এই দেখে আমাদের গাড়ি গতি আরো বাড়িয়ে দিলো ! আচমকা মনে হলো পাশ দিয়ে এসে সেটি আমাদের গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে আমাদের কে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে ! এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথাও বলে রাখা দরকার, এই গাড়িতে বসার সময়ে আমাদের প্রত্যেককে দুধরণের সিট বেল্ট বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ! যাতে, গাড়ি গতিতে আঁকা-বাঁকা পথ নিলেও কেও ছিটকে পরবে না ! শেষ পর্যন্ত, আমরা তার মুখের মধ্যে দিয়ে প্রায় দ্বিগুন গতিতে গাড়ি চালিয়ে একটা ছোট্ট গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে তার পথ থেকে বাচলাম ! কিন্তু তারপর যা দেখলাম, হাত-পা প্রায় ঠান্ডা হয়ে যাবার জোগাড় ! প্রায়, 10 তলা ওপরের এক স্লিপ থেকে আমাদের গাড়িটা সটান নিচে জলভর্তি একটা রেল লাইন এর ওপর এসে পড়লো ! তার সঙ্গে, সমুদ্রের ঢেউ এর মতো জল ছড়িয়ে গাড়ির গতি কমিয়ে দিলো !

তবে একটা কথা এখন বলি, এই পুরো শো-টা ছিল একটা 7-D ! এবং, এখানে সব চরিত্র গুলি হলিউড এর এক বিখ্যাত স্পেশাল ইফেক্ট কোম্পানি কে দিয়ে হলোগ্রাম এ প্রজেক্ট করে দেখানো হয়েছে ! তাই, দেখলে বোঝার উপাই ছিল না ! মনে, হচ্ছিলো সব কিছু চোখের সামনে ঘটে চলেছিল ! এরপর, এই গাড়িটা যেখানে থামলো, তার ভেতরে রয়েছে ভীষণ সুন্দর একটা একোয়ারিয়াম ও গিফটশপ !

এরপরে, আমরা এগিয়ে চললাম আরো একটা ভীষণ জনপ্রিয় অনুষ্ঠান দেখতে – “এন্টার্টিকা – পেঙ্গুইনদের সাম্রাজ্য” !

এর মধ্যে প্রচন্ড চড়া রোদে দাঁড়ানো খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছে ! যদিও মাঝে মাঝে বিশেষ জায়গা থেকে জল স্প্রে করে বাতাসে ছাড়া হচ্ছে, যাতে লাইন এ দাঁড়াতে লোকের কষ্ট না হয় ! প্রায় দেড় ঘন্টা দাঁড়ানোর পর অবশেষে আমরা দরজার কাছে পৌছালাম !

এখানেও আমাদেরকে একটা বিশেষ গোলাকৃতি গাড়িতে বসতে হলো ! এবং লোকজন এসে আমাদের সিট বেল্ট ভালো করে বাধা আছে কিনা পরীক্ষা করে তারপর চলে গেলেন ! এই গাড়ি গুলোতে কোনো চালক নেই ! এরা বিশেষ জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলে ! সুতরাং, আমাদের বসে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই ! এই সময়ে আমরা পেঙ্গুইনদের সম্পর্কে নানান অজানা তত্থ শুনতে পেলাম !

নানান রং-বেরং এর বরফের গুহার মধ্যে দিয়ে চলতে-চলতে আমরা পৌছালাম পেঙ্গুইনদের দেশে, যেখানে একটা মোটা কাঁচের দেওয়াল এর পেছনে রয়েছে তাদের কৃত্তিম দেশ ! আর স্বাভাবিক কারণে এই জায়গাটা ভীষণ ঠান্ডা ! কয়েকটা পেঙ্গুইন খুব গম্ভীর ভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো !

এরপরে, আমাদের গাড়ি আরো এগিয়ে চললো ! কিছুটা দূর গিয়ে আবার আরেকটা জায়গায় থামলো !
এর ই মধ্যে লক্ষ্য করলাম, একটা ছোট্ট পেঙ্গুইন খুব কৌতূহল নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ওর ডানা দিয়ে হাত নাড়লো !
অন্যদিকে, একটা পরিবারের বেশ কিছু পেঙ্গুইন খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যাস্ত ! আমাদের দিকে তাদের তাকানোর সময় টুকুও নেই !

|
 |
এই রকম সুন্দর অভিজ্ঞতার জন্য আমাদের কে সাউথ পোল এ পারি দিতে হলোনা ! বলা যেতে পারে এক টুকরো সাউথ পোল যেন আমাদের কাছে উঠে এসেছে !
এখান থেকে বেরিয়েই দেখলাম, একটা বড়ো কাঁচের একোয়ারিয়াম, সেখানে একজন লোক কোনো সাঁতারের কিছু না পরেই জলের মধ্যে নানারকম কেরামতি দেখাচ্ছে !
 |
এই লোকটি জলের মধ্যে রিং করে মুখ থেকে বাতাস এমন ভাবে ছাড়ছে যে সেটা নিখুঁত একটা বড়ো মালার মতো আকৃতি নিচ্ছে যত ওপরে যাচ্ছে !

|
তারপর, আমাদের কিছু সদস্যরা ঠিক করলো, সব থেকে বড়ো রোলার-কোস্টার রাইড এ তারা চড়বে ! যার উচ্চতা, প্রায় ২০ তলা বাড়ির সমান ! আমি নিচে থেকেই কিছু ছবি তুলবো বলে ঠিক করলাম !

সবাই ফিরে এলে ঠিক পৌনে চারটে নাগাদ আমরা আমাদের শেষ শো এর জন্য হাঠতে শুরু করলাম ! এই, শোটাই বিখ্যাত “সামু” বলে লোকের মুখে-মুখে পরিচিত !

আমরা ঠিক সময়ে গিয়ে মঞ্চের পাশে রাখা সিটগুলিতে বসলাম ! তার ঠিক ৫-মিনিট পরে শো-টি শুরু হলো ! এই পুরো অনুষ্ঠানটি একটা উদ্ধার করা তিমি কে নিয়ে ! তিমিরা যদিও খুব ই বুদ্ধিমান হয়, তবে এই তিমিটা সব থেকে বেশি বুদ্ধি ধরে ! এবং, এ মানুষের সঙ্গে নানান শব্দের মাধ্যমে কথা বলতে পারে ! যা, খুব এ অবিশাস্য ! এমন কি এও শোনা যায়, অন্য কোনো বন্য তিমি কেও এর সাহায্যে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া গেছে ! এইরকম, এক অদ্ভুত প্রাণীর কে নিয়ে এমন একটা অনুষ্ঠান না হওয়ার আর কোনো কারণ থাকতে পারে বলে মনে তো হয়না ! কিন্তু, জানা গেলো – এই স্বাধীন চেতা তিমি কে দিয়ে জোর করে অনুষ্ঠান করানোর জন্য দুবার সে তার পরিচালক কে মেরে ফেলে খেলা দেখানোর সময়ে ! তা দেখে সবাই হতবাক হয়ে যান ! এবং, সারা আমেরিকা তে এই নিয়ে আন্দোলন শুরু হয় ! এই প্রশ্ন উঠে আসে – “Sea-World এর কি আদেও সেই অধিকার আছে যেখানে একটা সমুদ্রের প্রাণীকে জোর করে এইভাবে অনুষ্ঠান করতে বাদ্ধ করতে পারে ? আর, তার থেকেও বড়ো হলো যারা এর সাথে খেলা দেখায়, তাদেরকে কিকরে এইরকম জায়গা থেকে রক্ষা করা যাবে ? এর দায়িত্ব কে নেবে যদি সেইসব খেলোয়াড়দের কিছু হয়ে যায় ? কিন্তু, শেষ পর্যন্ত এই তিমির কে সমুদ্রে ছাড়ার অনেক চেষ্টা করা হলেও, স্বাভাবিক কারণে সে তার সেই ক্ষমতা প্রদর্শনে অক্ষম হয় ! অবশেষে, Sea-World দায়িত্ব নেয় যে তারা সব কটা দিক খতিয়ে দেখে এগোবে ! শেষ পর্যন্ত এও ঠিক হয়, যদি কোনোদিন এই তিমি এর ব্যবহার এ কোনো পরিবর্তন হয়, সেইদিন তাকে দিয়ে কোনো অনুষ্ঠান করানো হবেনা ! শর্তসাপেক্ষে এই শো-কে আবার ছাড়পত্র দেওয়া হয় !

আমাদের অবাক করে দিয়ে এই তিমি এসে তালে-তালে ছন্দ মিলিয়ে নানানরকমের জল থেকে লাফিয়ে উঠে তার তালিম দেখাতে লাগলো ! ঠিক যেন বাড়ির পোষ্য বিড়াল ছানাটি !

শুধু তাই নয়, ওর পাচিলের কাছে বসে থাকা কিছু দর্শকের গায়েও দুস্টুমি বুদ্ধিতে জল ছিটিয়ে দিলো ! এবং, সেই সঙ্গে ওর হাসির শব্দও শুনতে পারলাম ! “সত্যি, কত কিছুই না আমরা এখনো জেনে উঠতে পারিনি” – এটাই মনে-মনে ভাবলাম !

এরপরে, আমরা বেরিয়ে এসে সবাই যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করছিলাম, যে আমাদের পৃথিবীতে জলের মধ্যে এরকম অনেক প্রাণী আছে যারা বুদ্ধিতে মানুষ এর থেকে কোনো অংশে কম যায়না !
বেরিয়ে আসার মুখে দেখলাম, একটা পুকুরের পারে বেশ কিছু সারস জল থেকে মাছ শিকার করে খাচ্ছে ! আর, সূর্যাস্তের আলোয় যেন জলের মধ্যে রুপালি পরশ পাথর এর ঝিলিক দিয়ে উঠছে ! সে দৃশ্য, যেন এই সুন্দর দিনটা কে শেষ করার কথা ঘোষণা করলো !

এই কথা শিকার করতে বাধা নেই যে, কিছুক্ষন এর জন্য যেন বিস্মকবির “ইচ্ছাপূরণ” এর দেশে চলে যেতে পেরেছিলাম ! ছোটবেলার অনেক আনন্দ কে তাই সেদিন আরো একবার ভীষণ উপভোগ করলাম ! এবং, তার সঙ্গে আমাদের অর্ল্যান্ডো তে ঘোরার কাহিনী শেষ হলো ! এরপরে, আমরা ছুটে চলবো মিয়ামি, ফ্লোরিডা তে !
আমি আমার সেই অভিজ্ঞতা খুব শিগগির সবার সাথে শেয়ার করবো ! তার আগে আপনারা, এই ঘোরার অভিজ্ঞতা কে কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন ! আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রইলাম !
ভালো থাকবেন ! সুস্থ থাকবেন ! এবং, বাড়িতে থাকবেন ! আবার দেখা হবে ! |