প্রথম পর্ব :
আমাদের বাড়িতে আগে প্রায়শই বহু লোক আসতেন বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন ! একটা ব্যাপারে তারা সবাই জানতেন যে আমাদের বাড়িতে আতিথেয়তার তুলনা সাধারণত অন্য বাড়ির থেকে একেবারেই আলাদা !

আর, তার এক মাত্র কারণ আমার বাবার লোক খাওয়ানোর যে পটুতা দেখাতেন, তা হয়তো অনেকেই ভাবতে পারবেন না ! অবশ্যই, আমার মার সেই ক্ষেত্রে অবদান অনস্বীকার্য ! মা না থাকলে সেই পরিকল্পনার বাস্তব হতো না !  আমার এই পর্বে আমি কিছু সেইরকম এক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত অভিজ্ঞতা আজ বলবো ! আশা করি সবার ভালো লাগবে !

দ্বিতীয় পর্ব – কাকুর আগমন :
আমার বাবার এক বন্ধু আমাদের বাড়িতে আগে ছোটবেলায় আসতেন ! তিনি খাবারের রসিক ছিলেন ! খেতে ভীষণই ভালোবাসতেন ! আর, আমার বাবা বাড়িতে কেও এলে তার যেন কোনো ত্রুটি নাহয়, সেদিকে যথেষ্ট নজর রাখতেন ! শুধু তাই নয়, খাওয়াতেও ভীষণ ভালোবাসতেন ! কাজেই, এইরকম ক্ষেত্রে ওদের দুজনের বন্ধুত্তের একটা শক্ত কাঠামো ছিল !

তখন, আমার গরমের ছুটি সবে পড়েছে ! সকালে, ঘুম থেকে ভোরে উঠতে হচ্ছে না ! আর, দুপুরবেলায় বাড়িতে বসে একটু বিশ্রামও পাওয়া যেত ! এইরকম, একদিনে সরিত-কাকু এসে হাজির ! সকাল দশটায় বাড়িতে দরজায় টোকা পরতে, দৌড়ে গিয়ে খুলে দেখি সরিত-কাকু দাঁড়িয়ে আছেন একগাল হাসি নিয়ে !

বাবা – কাকুকে দেখেই মাকে কাকুর জন্য স্পেশাল চিরের পোলাও করতে বললেন ! সেই কথা শুনে সরিত কাকু জানালেন যে তিনি সকালে বত্রিশটা রুটি দিয়ে সবে ব্রেকফাস্ট করে এসেছেন ! বাবা তাও মাকে চোখে ইশারা করে বললেন বানাতে ! আর কাকুকে বললেন – “আরে ধুর, ওত এতক্ষনে হজম হয়ে গেছে – এতটা দূরে এসেছো !”

মাও সেই শুনে বললেন – “ঠিক আছে – অল্প করেই করছি ! আজ সব উপকরণগুলো আছেও ! একটু নাহয় আজ চেখেই দেখবেন !” এই বলে মা রান্নাঘরে চলে গেলেন !

কিছুক্ষনের মধ্যে মা চিরের পোলাও বেশ পরিপাটি করে বানিয়ে আনলেন ! আর গন্ধটাও বেশ ভালো বেরিয়েছে ! মা একটা ছোট গামলাতে ভালো করে একটু আলু-ভাজা আর বাদাম-ভাজা দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করলেন !

কাকু মুখে বললেন – “ওবাবা ! বৌদি এতো কি করেছেন ? “

বাবা বললেন – “আরে খাও, খাও ! ঐটুকু তোমার জন্য কিছুই নয় !”

কাকুও বাটিটা হাথে তুলে খেতে শুরু করে দিলেন ! আর, মিনিট পনেরোর মধ্যে বাটি খালি হয়ে গেলো !

এরপর, বাবু বাইরে যাবার জামা-কাপড় পরে কাকুকে নিয়ে একটু বেরিয়ে গেলেন ! আর মাকে দুপুরে খাওয়ার রান্না করতে বললেন কাকুর জন্য ! এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো – আমরা বাড়িতে সাধারণত চারজনে যে পরিমানে ভাত খাই, কাকু একাই প্রায় সেই পরিমান ভাত খান ! আর, যেহেতু মা ভাত প্রেসার কুকারে বানাতেন, সুতরাং, সেই ক্ষেত্রে মাকে দুবার করে ভাত বসাতে হবে ! তা, মার সে অভিজ্ঞতা থাকায় আলাদা করে আবার কাকুর জন্য ভাত বসিয়ে দিলেন !

বাবারা ঠিক দুপুর দেড়টার মধ্যে ফিরলেন ! মা একটা কাঁসার থালায় কাকুর জন্য বরাদ্দ ভাতের অর্ধেকটা শুধু কাকুকেই দিলেন ! তার সঙ্গে চারিদিকে গোটা সাতেক বাটিতে ঝুরঝুরে আলু-ভাজা থেকে শুরু করে ডাল হয়ে, পোস্তর বড়া, লাউ-চিংড়ি, রুই মাছের কালিয়া, প্লাষ্টিক চাটনি আর সিমুইর পায়েস দিয়ে পরিবেশন করলেন ! আর, সঙ্গে ছোট্ট একটা কাঁচের বাটিতে ঘরে বানানো নতুন ঘি-টাকে দিয়ে পরিবেশন করলেন !

কাকু দেখে বললেন – “আরে বৌদি, কি করেছেন ? এইতো, একটু আগে তো চিরের পোলাও খেলাম ! “

বাবার সঙ্গে মাও বললেন – “আরে সেতো বেশ কিছুক্ষন আগে হয়েছে !” সঙ্গে মা এও বললেন – “আর তাছাড়া এতক্ষন তো বাইরে হেঠে আসলেন ! সে খাবারও তো হজম হয়ে যাবে !”

এরপর, কাকু আর বিশেষ কথা না বাড়িয়ে হাত ধুয়ে এসে বাবার সঙ্গে খেতে বসে গেলেন ! আমি খাটের ওপরে এমন জায়গায় বসে আছি, যেখান থেকে কাকুর খাওয়া-দাওয়াটা দেখতে পাওয়া যায় ! যদিও, খাবার সময় ঐভাবে সাধারণত আমি দেখি না ! কিন্তু, এই ক্ষেত্রে একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে ! সেটাকে আমি অগ্রাহ্য করতে পারিনি !

তৃতীয় পর্ব – খাদ্যাভ্ভাস :
এইরকম, সুন্দর পরিবেশন থাকলে কেই না অগ্রাহ্য করবে ? আর, তার ওপরে আমার মায়ের হাথের রান্না যথেষ্ট সুস্বাদু ! সুতরাং, সেক্ষেত্রে এই অধিবেশন ঠিক কতটা দূর অবদি চলতে পারে, সেটাই দেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল !

তার জন্য অবশ্য আমায় বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হয়নি ! শুরুতেই, বাবার সাথে গল্প করতে-করতে দেখলাম – কাকু গরম ঘি, সাদা ঝরঝরে ভাতে মেখে, ঝুরঝুরে আলুভাজার সাথে প্রায় অর্ধেক ভাত সাবাড় করে দিলেন ! এরপর, মা কাকুর ভাগের বাকি ভাতটুকু দিয়েই আবার আরেক হাঁড়ি ভাত চাপিয়ে দিলেন ! বলা যেতে পারে ভবিষ্যৎ-এর যোগানের কথা খানিকটা ভেবে ! এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে – আমাদের ভাগের প্রায় সত্তর শতাংশ ভাগ তখন আছে ! সুতরাং, কাকু আরেকটু ভাত চাইলে তার যোগান যেমন হবে, তেমনি কাউকে লজ্জার সম্মুখীনও হতে হবে না !

এইবারে কাকুর পাতের বাকি অর্ধেক ভাতটা ডাল আর পোস্ত দিয়ে উড়ে গেলো ! আমিও বুঝতে পারলাম, ভাগ্যিশ মা আগেভাগে আবার ভাত বসিয়ে দিয়েছেন !

মা আবার আমাদের ভাগের অর্ধেকটা ভাত কাকুকে দিয়ে দিলেন ! কাকু তখন বাবার সাথে গল্পে যেমন ব্যাস্ত, তেমনি খেতে-খেতে বারবার বলতে লাগলেন – “বৌদি অপূর্ব হয়েছে প্রত্যেকটা রান্না !”

মা হেঁসে বললেন – “বেশতো ! খান না ! একদম লজ্জা করে খাবেন না !”

এর মধ্যে আমাদের বিকল্প ভাতের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়ে গেছে ! মা আবার সেই ভাতটা হাঁড়িতে চালান দিয়ে টেবিল এর ওপর রেখে দিলেন ! কাকুর ভাত যখন প্রায় শেষ, তখন ও পাতে পরে আছে – রুইমাছের কালিয়া আর চাটনি !

মা তখন কাকুকে বললেন – “দাদা, একটু গরম ভাত করেছি ওটা দিয়ে এই মাছের কালিয়াটা খেয়ে বলুন !”

কাকু এবারে যেন একটু লজ্জা পেলেন – “এবাবা ! বৌদি আমি তো মনে হয় আপনাদের ভাতও খেতে ফেললাম !”

বাবা আর মা দুজনেই বলে উঠলেন – “আরে আমরা তো খেতাম ই ! অসুবিধা কি আছে ! আপনি খান !”

বাবা সাথে এও বললেন – “আরে ধুর এতো তোমার কাছে ব্রেকফাস্ট !”

এই কথা শুনে কাকু বললেন – “তাহলে অল্প একটু দিন !”

মা আবার নতুন করা ভাতের অর্ধেকটা কাকুকে দিয়ে দিলেন !

এইবারে, কাকু ওই দিয়ে মাছ দুটো নিমেষে শেষ করে দিলেন ! শেষে ভাত বেশি হয়ে যাওয়ায় – মা আরো দুটো বোরো গাদার পিস দিলেন কাকুকে ! তার, কিছুক্ষনের মধ্যে কালিয়া শেষ করে চাটনি শুরু হয়ে গেলো !

চতুর্থ পর্ব – পায়েস পর্ব :
মা যে বাটিটাতে পায়েস দিয়েছিলেন, সেটা আমাদের বাড়িতে যেকেও একবার খেলে হয়তো পাতের আসল ভাতটাই হয়তো খেতে পারবে না ! কাকু খেতে ভালোবাসেন বলে – মা একটা বড়ো জ্যাম বাটিতে করে প্রায় এক বাটি পায়েস দিলেন !

আর বাবারা সকালে যখন বেরিয়েছিলেন, তখন গরমের জন্য বাজারে পাওয়া ভীষণই সুন্দর গন্ধের হিমসাগর আর লিচু এনে ফ্রীজে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন !

এবারে, মা ফ্রীজ থেকে সেই ঠান্ডা ফল গুলো বার করে কেটে পাতে এগিয়ে দিলেন !

কাকু দিব্যি গল্প করতে-করতে নিমেষে আম আর লিচু শেষ করে উঠে গেলেন ! এতক্ষন, আমরা সবাই ভেতরে-ভেতরে অনেকটা অচেতন হয়ে দেখে যাচ্ছিলাম !

সত্যি কথা বলতে কি – নিজের চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই হতো না ! অনেকটাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলাম !

এরপর, বাবা আবার কাকুকে নিয়ে বেরোলেন কাছেই একটা নামকরা পানের দোকান আছে – সেখানে ! ভীষণ ভালো মিষ্টি-পান পাওয়া যায় !

আর, আমরা সেই সময়ে নিজেরা খেয়ে নিলাম ! মা সব কিছু গুছিয়ে, পরিষ্কার করে একটু বিশ্রাম নিতে শুয়ে পড়লেন !

এর মধ্যে বাবা আর কাকু একটু ঘুরে এসে ফিরলেন !

পঞ্চম (শেষ) পর্ব – মিষ্টি পর্ব :
বাবা ফিরে হাত-পা ধুয়ে আমায় বললেন মোড়ের গোপালের মিষ্টির দোকান থেকে ভালো দেখে কুড়ি টাকার মিষ্টি নিয়ে আসতে ! এ-প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো তখন রসগোল্লার দাম ছিল আট-আনা যা আজকের দিনে কুড়ি টাকায় মিলবে ! সুতরাং, সেই সময়ে কুড়ি-টাকার মিষ্টি মানে কিন্তু অনেকটাই ! এছাড়া, আমাদের স্থানীয় এলাকায় গোপালের দোকান কিন্তু খুব নামকরা ! কারণ, শুধু যে মিষ্টিগুলো অত্যন্ত সুস্বাদু নয়, ওরা অনেক ক্ষেত্রেই নতুন-নতুন বাহারে মিষ্টি আনতো ! যেটা সেই সময়ে আমাদের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় ছিল ! আর, গুনগত মান ও পরিমাণে সঠিক ! অর্থাৎ, ন্যায্য দাম !

সেই কথা মতো আমি টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেলাম ! এইবারে, আমি একটু পরীক্ষা করতে চাই ! আমি নিজে মিষ্টির ভীষণ পোকা ! কাজেই, সাধারণত, সব কাকুরাই মিষ্টি আনলে আগে বাড়ির ছোটদের দিয়ে তারপর নিজেরা খান ! কিন্তু, এক্ষেত্রে আমার বিশেষ ভরসা নেই ! তাই, আমি খুঁজে-খুঁজে সব থেকে কড়া-পাকের বেশি মিষ্টি দেওয়া সন্দেশ বা জলভরা নিয়ে এলাম ! গোটা কুড়ি পিস হলো ওই টাকায় ! আমি নিজেই একটা বড়ো থালায় সবকটা মিষ্টিকে গোল করে সাজিয়ে দিলাম !

কাকু বললো – “আরে আবার এসব কেন ? খেলাম তো এতো কিছু !”

বাবা বললেন – “আরে খেলে তো দুপুরের খাবার, মিষ্টিমুখ করবে না ? ওটা না হলে চলে !”

কাকু হেসে আমার থেকে প্লেটটা নিয়ে নিলেন !

একটা করে মিষ্টি কাকু শেষ করছেন – আর আমি মনে-মনে ভাবছি – “এবারে মনে হয় আর পারবেনা ! এবারে হয়তো আমাকে ডেকে দিয়ে দেবেন বাকি মিষ্টিগুলো ! তাহলে আমি দুদিন ধরে মজা করে খাবো !”

চলতে-চলতে শেষে দেখি পাতে আর দুটোমাত্র বাকি আছে ! তখন, আমার বেশ একটু অভিমানই হলো ! শেষের আগের মিষ্টিটা ছিল চিনি দিয়ে করা – দানাদার ! কিন্তু, সেটা আবার রসে ভরা ! আঠারোটা মিষ্টি শেষ করে উনিশ নম্বর মিষ্টিতে মনে হলো কাকু যেন একটু থামলেন ! এই একটা মিষ্টি আমি খুব একটা পছন্দ করিনা – অত্যাধিক চিনি থাকার জন্য !

কাকু উনিশ নম্বর মিষ্টিটা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – “কাকুভাই, মিষ্টি খাবে ?”

আমি বললাম – ” না কাকু ! আমার তো পুরো পেট ভর্তি ! তুমি খাও না ! হয়ে যাবে !”

কাকু দেখি আর কথা না বাড়িয়ে শেষ মিষ্টিটাও মুখে পুড়ে দিলেন ! আমি পুরো তাজ্জব হয়ে গেলাম ! যেন, নিজের চোখ, কান বা কোনো ইন্দ্রিয়কেই বিশ্বাস করতে পারছি না ! মনে-মনে ওনার খাওয়ার অদম্য ইচ্ছা আর পাঁচনশক্তির গুণগান না করে পারলাম না ! অবশ্য, একথা বলতে অসুবিধা নেই যে, ওনার খাওয়ার পরিমানের সঙ্গে চেহারার আপাতদৃষ্টিতে অনেক ফারাক আছে ! অর্থাৎ, ওনাকে দেখে কেও ভাবতেও পারবেন না – ওনার খাওয়ার পরিমাপ কত হতে পারে ! এই ব্যাপারটা এখন বড়ো হয়ে বুঝি ! খুব লোকেরই এই ধরণের ক্ষমতা থাকে ! অনেকে আবার মজা করে এও বলেন যে – “ওনার সরু পেটে গরু ধরে !” কিন্তু, আমি মনে করি এ এক বিশেষ ক্ষমতা !

এইরকম খাওয়ার এডভেঞ্চার জানিনা আর কে দেখেছেন বা সাক্ষী থেকেছেন ! তবে, তখনকার দিনে প্রায় প্রতিটা পাড়ায় হয়তো একজন করে কাকু, দাদা থাকতেন যারা এইরকম পারদর্শিতা দেখাতে পারতেন !

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ : সমস্ত ছবি আমার নিজের তোলা – এই ছবির সাথে গল্পের চরিত্রের কোনো মিল নেই ! নেহাৎ প্রচ্ছদের কারণে প্রতীকী হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে !
বিশেষ ঘোষণা :
  • আমার এই গল্পের মূল কাহিনীর সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই ! যদি, কোনো কারণে তা হয়েও থাকে, নিতান্তই কাকতালীয় !
আমার গল্প কেমন লাগলো তা এখানে একটা ছোট্ট-কমেন্টস দিয়ে জানালে খুব ভালো লাগবে !

আশা করি আপনারা সবাই ভালো থাকবেন ও সুস্থ থাকবেন !

@কপিরাইট – সাত্যকি দে
Subscribe বোতাম এ ক্লিক করুন আপনার ইমেইল দিয়ে, ও আরো অনেক ছবির সাথে ঘুরতে যাওয়ার গল্প পড়ুন !