প্রথম পর্ব :

সদ্য অংকে ডক্টরেট সম্পূর্ণ করে স্ট্যান্ডফোর্ড থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো অজয় ! শেষ বারের মতো তার অত্যন্ত প্রিয় ক্যালিফোর্ণিয়াকে বিদায় জানিয়ে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স-এর UA ৮৬৬ এর ফ্লাইটে উঠে পরে কানে হেডফোনটা লাগিয়ে দিয়ে জানালা দিয়ে সুন্দর পরিবেশটা দেখতে লাগলো ! প্লেনটা কিছুক্ষনের মধ্যে ওড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই সেটি প্রায় ছত্রিশ হাজার ফুট ওপরে উঠে চলতে থাকলো ! অজয়ের কানে একটু তালা লেগে যাওয়ায়, সিটের সামনে থেকে জলের বোতলটা একটু চুমুক দিতেই যেন কানের তালাটা কেটে গেলো ! এই, বোতলটা সে এয়ারপোর্ট থেকেই কিনেছে ! যদিও, সে অংকে ডক্টরেট করেছে, তার প্রিয় বিষয় হলো এমন কোনো বাস্তব ক্ষেত্রে এই বিদ্যা ব্যবহার করা, যা আপাতদৃষ্টিতে অংক দিয়ে করা প্রায় অসম্ভব !

অ্যাপ্লায়েড ম্যাথেমেটিক্সের বিশেষত্ব হলো এটাই ! যেকোনো স্বাভাবিক ঘটনাগুলোকে এরা অংকের জটিল ফর্মুলা দিয়ে তার এমন একটা প্রক্রিয়া বার করা, যা দিয়ে এই ধরণের ঘটনা খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা যায় ! ঘটনাটা নেহাৎ নতুন কিছু নয় ! আজকাল, বহু জায়গায় সারা বিশ্বে এর ব্যবহার চলছে ! আমাদের দেশেও চলছে ! অবশ্যই, তার প্রয়োগ আমাদের দেশে এই মুহূর্তে তুলনামূলকভাবে সীমিত ! আর, অজয় সেই সীমাকেই অসীম করার লক্ষে ভারতবর্ষকে বেছে নিয়েছে !

ফ্লাইট ছাড়ার এক ঘন্টার মধ্যে এয়ার-হোস্ট্রেস খাবার দিয়ে গেলো ! খাবার খেয়ে চোখে পাতলা ব্যান্ডটা পরে নিলো ! চশমা না থাকায়, এই ব্যান্ডগুলো পরা খুবই সুবিধার ! আর, তার থেকেও বড়ো হলো এই ব্যান্ডগুলো পড়লে ফ্লাইট চলাকালীন ঘুমোতে খুব সুবিধা হয় ! কারণ, বাইরে থেকে কোনো আলো চোখের মধ্যে ঢোকেনা !

ঘুমোতে-ঘুমোতে ছোটবেলার সব বন্ধুদের কথা মনে পড়তে থাকলো ! সঞ্জীব, অমর, শৈবাল, মিঠু আর মৌপ্রিয়া ! অবশ্য, আজ এরা সবাই কর্মসূত্রে কলকাতার মধ্যে হলেও খুবই ব্যাস্ত ! যে যার নিজের কাজ আর সংসারে ঘিরে আছে ! কিন্তু, হোয়াটস্যাপ গ্রুপে ছোটোখাটো চুটকুলা থেকে আরম্ভ করে মজার-মজার গল্প ও ছোটবেলার স্মৃতিকথা কিন্তু হয় ! তাই, সেইসব শুনতে কিন্তু অজয়ের বেশ ভালোই লাগতো ! অন্তত, বাড়ির একটা টাচ তো থাকতো !

এই যেমন সঞ্জীবের কথাই ধরা যাক ! কলকাতার জাদুঘরে বেশ একটা উচ্চপদস্থ স্থানে কাজ করছে ! অমর একটা বেসরকারি ব্যাংকের ইস্টার্ন-রিজিওনাল হেড ! ভালোই কানেকশন আছে ! শৈবাল আবার কলকাতার মুকুন্দপুরে একটা নামকরা বেসরকারি হাসপাতালের এমডি ! মিঠু বালিগঞ্জ গার্লস হাই-স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ! আর, মৌপ্ৰিয়া হলো কলকাতা ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্টের “ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশ” ! কিন্তু, আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮-এর জানুয়ারীতে অজয় যখন এসেছিলো, তখনও পর্যন্ত সবার মধ্যে ছোটবেলার সেই অকৃত্তিম বন্ধুত্বটা কিন্তু থেকে গেছে ! কাজেই আশা করা যায়, ২০১৯ এর মার্চেও তা বজায় থাকবে ! ২০১৮ সালের ঘোরাটা অবশ্য আরো একটা অন্য কারণেও স্পেশাল ! শুধু ভারতেই নয়, শৈবালের সাথে ওর এক পিসির বাড়ি ঢাকায় সাতদিনের জন্য ঘুরে এসেছিলো ! সেটাও এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা !

দ্বিতীয় পর্ব :

লন্ডনে নেমে সিকিউরিটি চেক-ইন করে নিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে একটা বার্গার আর কোল্ড-ড্রিঙ্কস নিয়ে বড়ো স্ক্রিনের পর্দায় চোখ পড়লো ! বিশেষ হেডলাইনসে একটা জিনিস চোখে পড়লো ! ভারতের পশ্চিম-বঙ্গ থেকে শতাব্দী প্রাচীন এক বৌদ্ধ পাণ্ডুলিপি উদ্ধার হয়েছে ! ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সেটার গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করছে ! এই মুহূর্তে জানা গেছে যে খুব সম্ভবত পাল সাম্রাজ্যের সমসাময়িক এই পাণ্ডুলিপি ! তার থেকেও বড়ো হলো সমস্ত টিভি সাংবাদিকদের সামনে যিনি বলছেন সেই মানুষটিকে বহুদিন ধরেই অজয় চেনে ! তিনি আর কেও নন – তার ছোটবেলার লুকিয়ে আলু-কাবলি খাওয়ার সাথী সঞ্জয় !

খবরটা দেখে অজয় চট করে গ্রুপে একটা পোস্ট করে দিলো ! “কিরে, তোকে তো ব্রিটিশ লোকেরাও চিনে ফেলবে ! এই মাত্র স্কাই-নিউস এ তোর ইন্টারভিউ এখানে এয়ারপোর্টে সম্প্রচার করা হলো ! জাতা ব্যাপারতো ! তুই তো পুরো সেলিব্রিটি হয়ে গেলি ভাই !”

সঞ্জয় বললো – “সেকিরে ? আমরা এই মুহূর্তে খবরটা খুব একটা বাইরে প্রকাশ করতে চাইছিনা ! যেটা হাথে পেয়েছি, সেটা বেশ পুরোনো ! কিন্তু, যে ভাষায় লেখা আছে – সেটার অক্ষর আরও পুরোনো ! কিন্তু, সেই ভাষার সঙ্গে যদি তাল মিলিয়ে মানে বুঝতে যাই, তাহলে আবার তার কোনো মানে নেই ! পুরোটাই অগোছালো, কেমন একটা সাংকেতিক ! অথচ, আমরা এটাকে উপেক্ষাও করতে পারছিনা ! কারণ, যাতে লেখা হয়েছে – সেটা কোনো প্রকৃত পাণ্ডুলিপির আদলে করা হলেও তার বয়স আনুমানিক দুশো বছরের পুরোনো তো কমপক্ষে হবেই ! সব মিলিয়ে, আমরা সম্পূর্ণ অন্ধকারে ! এর বেশি এখন কিছু বলবো না ! তুই আয় আগে কলকাতা ! সামনা-সামনি সব বলবো !

অজয় যদিও ইতিহাসের ছাত্র নয়, তবু ওর ইতিহাসের এইসব বিচিত্র ঘটনা জানতে বা পড়তে বেশ ভালোই লাগে ! আর যাই হোক, এই বয়সে এসে টেনে মুখস্থ করে পরীক্ষা তো দিতে হবে না ! তাই, ইতিহাসের প্রতি আর ওই বিতৃষ্ণা নেই ! বরং, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা আছে – ইতিহাসের এই ধরণের পাণ্ডুলিপি থেকে নানা ধরণের এনক্রিপশন বা সাইফারের আবির্ভাব হয়েছে ! যা কোনো না কোনো অংকের হিসাবে চলে !

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে পুরোনো কালে গোপন তত্থ সংগ্রহ করে অনুগতরা দেশের রাজার কাছে পাঠানোর জন্য এই ধরণের বহু পদ্ধতি ব্যবহার করতো ! যাতে, আপাত দৃষ্টিতে অক্ষরগুলো চেনা পরিচিত হলেও, তার কোনো মানে সাধারণ অর্থে নেই ! বিশেষ কোনো শব্দ যা ওই অনুচ্ছেদকে সঠিকভাবে অনুবাদ করতে সক্ষম হয় !

আরো সহজ উদাহরণ হলো, আজকের দিনে ফোনের কোনো সফটওয়্যার যেমন হোয়াটস্যাপ, সিগন্যাল বা হাইকের মাধ্যমে আমরা আমাদের কোনো বিশেষ বন্ধুকে বা আমাদের প্রিয়জনকে বা তাদের তৈরী কোনো গ্রুপে নানারকমের তথ্য দেওয়া-নেওয়া করি ! এখন, আমাদের ওই বিশেষ চাবি আমাদের যাতায়াতের তথ্যকে উল্টে-পাল্টে এমন একটা বাক্যে পরিবর্তন করে দেয় শব্দগুলোর পরিবর্তনের মাধ্যমে বা তাদের স্থান পরিবর্তন করে দিয়ে, যাতে বাইরে থেকে কেও ওই বাক্য দেখতে পারলেও তার মানে উদ্ধার করতে পারবে না !

পুরো ব্যাপারটা শোনার পর অজয় বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লো ! আপাতত, কলকাতায় নামার অপেক্ষা ! এরই মধ্যে ইন্টারনেটের সংবাদ থেকে যতটা পারলো সেই সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলো ! সংবাদ মাধ্যম থেকে যতটুকু জানতে পারলো তা হচ্ছে খানিকটা এইরকম – “চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার পুরোনো মালদার এক মন্দির থেকে ! মৃতপ্রায় ওই সাড়ে তিনশো বছরের পুরোনো মন্দিরটির সংস্কার করতে যায় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কিছু লোকজন ! কাজ শুরু করার আগে ভাঙাচোরা অংশগুলোর কাজের নমুনা ফোটোগ্রাফি করতে গিয়ে একটা ছোট শুরু কুঠুরির মধ্যে একটা প্রাচীন কাঠ-বাক্সের ভেতরে কাপড়ে মোড়ানো ছিল এই পাণ্ডুলিপি !”

এই পাণ্ডুলিপির বিশেষত্ব হলো এটি খুব সম্ভবত দেবনাগরী আদলের একটি পাণ্ডুলিপি ! কিন্তু, এতে ব্যবহৃত অক্ষরগুলি হলো গুপ্ত যা কিনা ব্রাহ্মী ও দেবনাগরির মাঝের সময়ের ! কিন্তু, এর ব্যবহার ও শব্দের মানে কিন্তু কোনো অংশেই গুপ্ত, ব্রাহ্মী বা দেবনাগরী নয় ! কারণ, তিন ভাষা পারদর্শী এই অক্ষরগুলো পরীক্ষা করে এটাই বলেছেন – “অক্ষরগুলো গুপ্ত হলেও যেভাবে সাজানো হয়েছে তা ওইভাবে প্রাচীন-ভাষাতে প্রয়োগ হয়না ! অথচ, যেভাবে যতটা যত্ন নিয়ে এই পাণ্ডুলিপির আধুনিক প্রতিকৃতির মধ্যে সাংকেতিক এই লেখা রেখে দেওয়া হয়েছিল, তা থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে, যিনি বা যারা লিখেছেন – তাঁর বা তাদের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম ! তাই, একে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছেনা !”

খবরটা পরে অজয়ের চোখটা চকচক করে উঠলো ! কি যেন একটা ইঙ্গিত আছে এতে ! কোনো প্রাচীন অংক দিয়ে তৈরী ধাঁধা কি ? কারণ, ও চট করে হিসাব করে বুঝলো – সেই সময়ে ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য ! তারাই হর্তা-কর্তা ! কাজেই, সেইরকম কোনো মানুষের তৈরী কি ? আর, তৈরী করলেও কেন ঐভাবে রেখে দেওয়া হয়েছিল ! এইসব, অজস্র প্রশ্ন অজয়ের মাথায় পাক খেতে লাগলো !

না ! একবার নিজের চোখে না দেখলে হচ্ছেই না ! একবার দেখে নিতে হবে ! ভাবতে-ভাবতে হঠাৎই শুনতে পেলো তার পরবর্তী লেগের ফ্লাইটে অনবৰ্ডিং শুরু হয়ে গিয়েছে ! অর্থাৎ, এবারে লন্ডন থেকে কলকাতার পর্ব ! আপাতত, ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়লো অজয় ! কিছুক্ষনের মধ্যে সিটে বসে – কানে আবার হেডফোনটা লাগিয়ে ইউটুবে কলকাতার নিউস চ্যানেল গুলো উল্টে-পাল্টে এই খবরটা খুঁজতে লাগলো ! আরো যতটুকু জানা যায় ! বিশেষ আর কোনো খবর না পেয়ে খানিকটা হতাশ হয়ে বন্ধ করে দিলো ! এরই মধ্যে এয়ার-হোস্ট্রেস ডিনার দিয়ে চলে গেলেন ! খাবার খেয়ে এবারে সিটের পিছন দিকটা একটু হেলিয়ে দিয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করলো ! এখনো প্রায় আট ঘন্টা !

এরই মধ্যে সে কখন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে ! চোখ যখন খুললো, তখন ফ্লাইট ট্র্যাকারে দেখাচ্ছে প্লেন কাজাকিস্তান অতিক্রম করে আফগানিস্তান ঘেঁষে ভারতের দিকে এগিয়ে চলেছে ! পাইলট ঘোষণা করে দিলেন আর সাড়ে তিন ঘন্টার মধ্যে প্লেনটি কলকাতায় পৌঁছে যাবে ! সেই সঙ্গে সকালের জলখাবারের দেয়ার কথাও জানিয়ে দিলেন ! যাতে সমস্ত প্যাসেঞ্জেররা মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে আসার সময় পান ! ব্রেকফাস্ট করে এয়ারহোস্ট্রেস যখন ট্র্যাশ সবার সিট থেকে নিয়ে গেলো, ততক্ষনে প্রায় আড়াই ঘন্টা কেটে গেছে ! প্লেন এখন দিল্লী আর কলকাতার মাঝে ! আর এক ঘন্টা পর কলকাতা ! নিজের সেই চেনা পরিচিত জায়গা ! নিজের শহর ! পাড়ার বন্ধুরা ও আরো কত কি ! ঠিক বিকেল পাঁচটা নাগাদ প্লেনটা কলকাতা বিমানবন্দরে নামলো ! ইমিগ্রেশন করে ব্যাগ নিয়ে বেরোতে-বেরোতে আরো ঘন্টা খানেক ! হোয়াটসাপে গোটা চল্লিশেক মেসেজ ঢুকে গেছে, কলকাতা বন্ধুদের আর ক্যালিফর্নিয়া বন্ধুদের তরফ থেকে ! বাড়ি থেকেও কল জানতে চেয়ে আর কতক্ষন লাগবে এয়ারপোর্টের বাইরে আসতে ! আজ অজয়ের গোটা পরিবার এসেছে ! ওর, বাবা, মা, দাদা, দিদি ও আরেক ছোট বোন ! সবাই অধীর আগ্রহে তাদের বাড়ির ছেলের জন্য অপেক্ষা করছে ! সদ্য ডক্টরেট পাওয়া মানুষটা প্রায় এক বছর পর দেশে ফিরছে !

তৃতীয় পর্ব :

অবশেষে, এয়ারপোর্টের সব ঝামেলা চুকিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো অজয় ! বাড়ির সবাই তখন প্রায় একই সাথে জড়িয়ে ধরে ! ঘরের ছেলে কঠিন পরিশ্রম করে নতুন উপাধি আর জ্ঞান অর্জন করে এসেছে ! এতো সহজে কি ছাড়া যায় ! সবার সাথে হাসতে-হাসতে কথা বলে ব্যাগ গুলো গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দাদার কেনা সদ্য সাত সিটের সেডান গাড়িটার সামনে গিয়ে অজয় বসলো ! আজ ছুটি বলে দাদাই গাড়ি চালাচ্ছেন ! গাড়ি এবারে “নতুন-রাস্তা” ধরে তীব্র গতিতে ছুটতে শুরু করলো ! গন্তব্য – কালিকাপুরে ! তাদের, নতুন কেনা ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠবে !

গাড়িতে যদিও বাড়ির লোকেরা আমেরিকার খবর ও ওখানে ভোটের প্রস্তুতি পর্ব সম্পর্কে জানার কথা বললেও, অজয়-এর মনের মধ্যে কিন্তু সেই পাণ্ডুলিপি ঘুরপাক খাচ্ছে ! দাদা দেবজয় যদিও গাড়ি চালাচ্ছিলেন, কিছুটা গেস করে ওকে জিজ্ঞাসা করলো – “কি ভাবছিস ? কিছু ফেলে এসেছিস নাকি ?”

শুনেই অজয় এর ছোটবোন রুমার দুস্টুমিভরা হাসিতে বলে ওঠা – “দাদাভাই, কোনো বিশেষ কাউকে ফেলে আবার আসোনি তো ? থাকলে বলে দাও ! আমাদের এখানে তাহলে ঝক্কি পোহাতে হবে না !”

শুনেই মা বলে উঠলেন – “হাঁ ! এইবার, ওটাই করতে হবে ! অনেক পড়াশোনা হয়েছে ! এবারে, একটু বৌয়ের মুখ দেখি ! আর কতদিন ?”

শুনেই অজয় কটমট করে বোনের দিকে তাকাতেই বোন “হো-হো” করে হেসে উঠলো ! আর বললো – “মা – গত এক বছর ধরে এই কথা বলে আমাদের মাথা খেয়েছে ! এবারে, তুমি সামলাও !”

বাবা বলে উঠলেন – “আরে, ছেলেটা সবে এলো – এখনো ঘরেই ঢোকেনি ! তার মধ্যে তোমার বাজনা শুরু করে দিলে ? একটু থিতু হতে দেবে তো ?”

অজয় বলে উঠলো – “আরে না না ! ঠিক আছে ! আপাতত, আমায় একটা সঞ্জয়কে ফোন করতে হবে ! আমার ফোনে একটুও চার্জ নেই !”

দাদা শুনে বলে উঠলো – ” ওবাবা ! অনেকদিন পর শুনলাম নামটা ! তা ওর জাদুঘরে কাজ কর্ম কেমন চলছে ?”

দাদা কথা বলার শেষ করার আগেই ছোটবোন বলে উঠলো – “ওবাবা, দাদা – তুই জানিস না ! ওতো এখন কলকাতা জাদুঘরে বিশাল পোস্টে আছে ! কালতো ওকে খবরেও দেখালো – মালদায় কি একটা খুঁজে পেয়েছে ওদের ডিপার্টমেন্ট ! “

শুনে দেবজয় বলে উঠলো – “ওবাবা ! তাই নাকি ? আমার যা কাজের চাপ পড়েছে ! খবর দেখারও সময় নেই ! তাহলে, কলকাতা জাদুঘর কাজকর্ম করছে ! ভাবা যায় !” – বলে খানিকটা মুচকি হাসি দিয়ে ওর নিজের মোবাইল ফোনটা অজয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলেন !

অজয় ফোনটা নিয়ে, নিজের ফোনের থেকে কোনোরকমে নম্বরটা কপি করে নেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে নিজের ফোনটা সুইচ-অফ হয়ে গেলো ! ভাগ্যিস, নম্বরটা কপি করা হয়ে গেছে ! এরপর, দাদার ফোন থেকে কল করলো সঞ্জয়কে !

অচেনা নম্বর থেকে ফোন দেখে উল্টো পার থেকে খুব গম্ভীর প্রফেশনাল গলায় ভেসে উঠলো – “হ্যালো ! সঞ্জয় বলছি ! কে বলছেন ?”

অজয় বললো – “আরে অজয় বলছি ! “

সঞ্জয় বললো – ” ও ! এটা আবার কার নম্বর ? “

অজয় বললো – “দাদার ! এই জাস্ট নেমে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছি ! কাল তোর থেকে ইনফর্মাশনটা পেয়ে, আরও কিছু তথ্য ইন্টারনেট থেকে খুঁজে পেলাম ! কাল প্লেনের মধ্যেও ঘুমোতে পারিনি এই নিয়ে ! সারাক্ষন, মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে ! একবার, জিনিসটা দেখা যায় ?”

সঞ্জয় বললো – “তার জন্য তোকে মৌপ্ৰিয়ার থেকে পারমিশন নিতে হবে ! কারণ, ওর তত্ত্বাবধানে পান্ডুলিপিটা মালদা থেকে এনে আপাতত কলকাতার এক সেফ-হাউস এ রাখা হয়েছে ! তারও দায়িত্ব মৌর ! এবং, যতক্ষণ না এক্সপার্ট কমিটি এই পাণ্ডুলিপির গুণগত মান নির্ণয় করবে, ততদিন ওর তত্ত্বাবধানেই থাকবে গুরু ! এখানে, আমি কিছু নোই ! বুঝলে ?”

অজয় বললো – “তুই মৌয়ের সাথে একটু কথা বলে রাখ ! আমি বাড়ি গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে আজ রেস্ট নেবো ! কাল আর্লি মর্নিংয়ে তোর ডেরায় পা রাখছি ! তার, আগে যদি একটু ব্যবস্থা করে রাখতে পারিস ! কিছুই না ! কিছু বিশেষ জিনিস শুনে মনের মধ্যে কয়েকটা খটকা দানা বাঁধছে ! একবার জাস্ট একটু যাঁচিয়ে নিতে চাই ! বেশি সময় আশা করি নেবো না !”

কথা শুনে সঞ্জয় বলে উঠলো – “আরে গুরু, তোমায় তো ওয়েলকাম করাই হয়নি ! ওয়েলকাম টু কলকাতা ! পার্টিটা কবে আর কোথায় দিবি ? জানিয়ে দিস ! সেই মতো পুরো গ্যাং নিয়ে হাজির হয়ে যাবো !”

অজয় শুনে বললো – “সেতো নিশ্চই ! সে আবার বলতে হবে নাকি ? তোরা জায়গা আর সময় ঠিক কর ! আমি দেব !”

শুনে সঞ্জয় বলে উঠলো – “জিও কাকা ! সব জানাচ্ছি পাকা করে আজ রাতেই !”

এই বলে অজয় ফোনটা কেটে দাদার কাছে ফিরিয়ে দিলো !

এতক্ষন সবাই চুপ করে অজয়ের ফোনের কথাবার্তা শুনছিলো ! ওর বাবা বলে উঠলেন – “তুই আবার ইতিহাসে কবে ইন্টারেস্ট নিলি ? আমি তো জানতাম ইতিহাস যে দিকে, তুই তার দু-হাত দূর থেকে চলে যাস !”

অজয় হেসে বললো – “না ! কেমন একটা আনামলি মানে সন্দেহজনক কিছু একটা আছে ! যেটা বোঝার চেষ্টা করছি ! আর, তাছাড়া এখনতো আমায় কেও মুখস্থ পড়া ধরবে না, আর ভুল বললেও ধমক দেবে না বা নম্বর কমে যাবে না ! তাহলে আপত্তি কোথায় ?”

এই কথা শুনে মা বলে উঠলেন – “বাবা ! তোর যদি এতটুকু আগ্রহ দেখতাম ছোটবেলায়, কত সময় যে কাটিয়েছি তোর শুধু ইতিহাসের পেছনে দূরদর্শনে রামায়ণ না দেখে, সেই গুলোতো মিস হতো না ! তোর খাটুনির সঙ্গে আমারও খাটুনি কম হতো !”

দাদা বলে উঠলেন – “তাও তো আমি ওকে সাজেশন বানিয়ে দিতাম ! কুড়িটা প্রশ্ন পড়তে বলতাম ! সেখান থেকেও বাবু সুপার সাজেশন করে দশটা পরে যেতেন ! আর, অদ্ভুত ব্যাপার হলো – তার নব্বই ভাগও কমন ও পেতো ! সত্যি ! কি করে যে তোর এতো সাহস জুটতো ?”

অজয় হেসে বললো – “দাদা তখন না জেনে করতাম ! আর, এখন জেনে বুঝে করি ! এটাকেই বলে অ্যাপ্লায়েড ম্যাথেমেটিক্স ! বুঝলে ? সব কিছুর পেছনে একটা অংক আছে ! আমার সাজেশন তৈরী করা থেকে, স্যারের প্রশ্নপত্র তৈরী ! একটা মডেল কাজ করে ! শুধু, মডেলটা ভালো করে বুঝতে হয় !”

দাদা বলে উঠলো – ” বলিস কি রে ? আমাদের মানুষের বিহেভিয়ার অংক দিয়ে বোঝা যাবে ? “

অজয় বললো – ” স্ট্যানফোর্ড উনিভার্সিটিতে এর ওপর অনেক রিসার্চ হচ্ছে ! ওরা অংকের মডেল ব্যবহার করে অনেক সময় যারা রেগুলার অফেন্ডার, তাদেরকে ধরে ফেলে ! শুধু তাই নয়, আজ এই ধরণের মডেলের জোরে কারোর ব্লাড ক্যান্সার হতে পারে বা অন্য কোনো অটো-ইমিউন ডিসিস সেসব কিছুই প্রেডিক্ট করতে পারে ! এবং, ওরা যে বলবে – তার শতকরা বিরানব্বই ভাগই মিলে যায় ! কাজেই বুঝতে পারছো – অংকের জোর প্রায় সব জায়গায় !”

বাড়ির সবাই শুনে অবাক হয়ে গেলো ! এর মধ্যে গাড়ি বাড়িতে পৌঁছে গেছে ! অবশেষে, দীর্ঘ সাত বছর পর পাকাপাকি কলকাতার বাড়িতে থাকার জন্য অজয় প্রবেশ করলো !

চতুর্থ পর্ব :

সেদিনকার মতো বাড়ি ফিরে সবার সাথে আড্ডা মারতে-মারতে রাতটা কেটে গেলো ! তার ওপরে বাড়ির সবার সুপার-আতিথেয়তা ! বৌদির হাথের ইভনিং স্নাক্স, মা আর বোনের হাথের রান্না খেয়ে মোটামোটি কুপোকাত ! সেদিনকার মতো তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো অজয় ! পরের দিন সকালে অনেক ভোরেই উঠে পড়েছে ! জেটল্যাগ এর জন্য রাতে খুব ক্লান্ত থাকলেও ঠিক মতো ঘুম হয়নি ! অজয় এও জানে যে এই জেটল্যাগ কাটতে কিছুদিন সময় লাগবে ! ততদিন, দিনের বেলায় প্রচন্ড ঘুম পাবে আমেরিকার রাত হওয়ার কারণে, আর ভারতের রাতে ঘুম আসবে না !

সকাল আটটায় মায়ের হাথের চা খেয়ে লোকাল নিউসপেপার-এ একটু চোখ বুলিয়ে নিতে থাকলো ! ভেতরের দিকে একটা পাতায় ছোট্ট করে এই পাণ্ডুলিপির ঘটনার আরো কিছু বিবরণ থাকলেও, সেগুলো নিছকই সাংবাদিকের মনগড়া কাহিনী লাগলো ! বলা যেতে পারে এধরণের চটকদার খবর বেচে আমেরিকাতে অনেক ছোটোখাটো সংবাদপত্র তাদের কাটতি বাড়ানোর চেষ্টা করে ! আমেরিকাতে এই ধরণের খবরকে “স্কুপ” বলে ! এতে খবরের উপাদান কম থাকে ! বাকি সব কিছুর আধিক্য থাকে !

এরই মধ্যে ফোনটা বেজে উঠলো ! উল্টোদিকে মৌপ্ৰিয়ার গলা – “কি করছিস? বাবাঃ অবশেষে এলি ! আমি তো ভাবলাম আর আসবি না ! যাই হোক, শুনলাম তুই নাকি পান্ডুলিপিটা দেখতে চাইছিস ? তা অংকের গুরু, ইতিহাস নিয়ে কি করবে ?”

অজয় বললো – ” আসলে দুনিয়াটা সব ছোট্ট হয়ে আসছে ! সব কিছুই মিলে-মিশে হচ্ছে একাকার ! তাহলে, অংকের লোকই বা কেন ইতিহাস নিয়ে ইন্টারেস্ট দেখাবে না কেন ?”

হেসে মৌপ্ৰিয়া বললো – “ওফফ ! তোর নাটুকে স্বভাবটা আর গেলো না !” আরো বললো – “ঠিক আছে, আজ দুপুর বারোটায় আসিস লালবাজারের ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্টে ! এসে বলবি আমার সাথে অপোইনমেন্ট আছে ! আমি বাইরে থাকবো ! তবে, তার আগেই চলে আসার চেষ্টা করবো ! নাহলে, একটু অপেক্ষা করবি ! তড়বর-তড়বর করবি না ! শান্ত হয়ে বসে থাকবি ! বুঝলি ? ” – এই বলে হেসে ফোনটা রেখে দিলো !

অজয় খানিকটা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলো ! ওকে বলার কোনো সুযোগই দিলো না ! তারপর, মনে-মনে ভাবলো – পুলিশের লোক হয়ে গেছে তো, তাই ওই বেশি বলে ! লোকে না শুনলেও চলবে হয়তো !

ঠিক দুপুর বারোটার আগে অজয় পৌঁছে গেলো লালবাজারে ! গেটের কাছে গিয়ে মৌপ্রিয়ার কথা বলতেই ওকে জুনিয়র অফিসাররা একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলেন !

বেশিক্ষন, অপেক্ষা করতে হলো না ! কিছুক্ষনের মধ্যে মৌপ্ৰিয়া পুলিশের ড্রেস পরে ঘরে ঢুকলো ! অজয় অবশ্য কখনো এই পোশাকে আগে ওকে দেখেনি ! খানিকটা অবাক হয়ে দেখতে থাকলো ! মৌপ্ৰিয়া হেসে বললো – “ঐভাবে দেখিস না ! নাহলে স্পেসিফিক পিনাল কোডে থানায় ঢুকে জাবি ! সেটা কি আমার ভালো লাগবে বল ? “

এই কথাই খানিকটা লজ্জা পেয়ে অজয় বললো – “শুরু করে দিলিতো আমার পেছনে লাগা ?”

মৌপ্ৰিয়া হেসে বললো – “হেহে ! কেন করবো না বল ? কত্তদিন পর তোকে দেখছি ! যাই হোক, এই দেখ – আসল জিনিসটা ! যেটার জন্য এসেছিস ! দেখে বল – কিছু বার করতে পারিস কিনা ?”

একটা অত্যন্ত ডেকোরেটেড তাঁতের তৈরী কাপড়ের থেকে একটা পাণ্ডুলিপি বার করে দিলো ! এ-প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো – কিসুন্দর একটা ফুলের গন্ধে ঘরটা মো-মো করতে লাগলো !

এই পান্ডুলিপিটা দেখতে ভীষণই জমকালো ! অজয় বেশ ভালো করে দেখে বললো – “কি দেখে তোরা বুঝলি যে এটা অরিজিনাল পাণ্ডুলিপি নয় ?”

মৌ বললো – “এটা তুই সঞ্জয়কে জিজ্ঞাসা করতে পারিস ! আরো ভালো উত্তর পাবি ! তবে, যতটুকু আমি শুনেছি আর বুঝেছি – “এইরকমই দেখতে আরো কিছু পাণ্ডুলিপিতে গুপ্ত অক্ষর পাওয়া যায়, যা বাংলার রাজা “পাল”-সাম্রাজ্যের সমসাময়িক ! কিন্তু, তাতে কিছু তফাৎ আছে ! সেই যুগে এইধরণের পাণ্ডুলিপিতে অনুচ্ছেদের মাঝে একটা বিশেষ অন্তরে কোনো ফুল বা ঐধরণের প্রাকৃতিক উদ্ভিদের ছবি থাকতো ! যা এই পাণ্ডুলিপিতে নেই ! আর তাছাড়া আইসোটোপ টেস্টিং করেও ওরা এটা জানতে পেরেছে যে এর বয়স তিনশো থেকে আড়াইশো বছরের মধ্যে ! কিন্তু, গুপ্ত লেখা যে সময়ে চলতো, সেই সমসাময়িক পাল বংশের সময়কাল কিন্তু বেশ আগে ! ছবি দুটো দেখে সঞ্জয় পার্থক্যটা ধরতে পারলো ! যদিও এদের আদলটা এক হলেও ওই পার্থক্যটা চোখে পড়ার মতো !”

“এই দেখ সেই সময়কার একটা পাণ্ডুলিপি !” – বললো মৌ !

“আর তার সঙ্গে আমাদের পাণ্ডুলিপিটা দেখে তফাৎটা দেখ !” – আরো বললো মৌ !

অজয় বললো – “হাঁ ! ধর্মপাল এর রাজত্বকাল ৭৭০ থেকে ৮১০ খ্রিস্টাব্দ ! আর, দেবপাল এর রাজত্বকাল ৮১০ থেকে ৮৫০ ! এই সময়ে পাল বংশের সব থেকে বেশি উন্নতি ও বিস্তার হয়েছিল ! এবং, এর বিস্তার একদিকে বাংলা থেকে আসাম, বিহার হয়ে পশ্চিমে কাবুল পর্যন্ত বিস্তার করেছিল ! দক্ষিণে প্রায় বর্তমান কর্ণাটকের একভাগ ও তামিলনাড়ু পর্যন্ত বিস্তার হয়েছিল !”

এই কথা শুনে মৌ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো – “তুই কি স্ট্যানফোর্ড গিয়ে ইতিহাসের ওপর ডক্টরেট করেছিস নাকি ?”

শুনে অজয় হেসে বললো – ” না ! তবে, জানিনা কেন আমার এই পুরো ব্যাপারটা ভীষণ ইন্টারেষ্টিং লাগছে !”

“আমি আজ সকালে উঠে আমার ল্যাপটপে গুপ্ত অক্ষর গুলোকে নোট করে নিয়েছি ! এখন, চট করে একটু দেখে নি !” – বললো অজয় !

মৌ বললো – “তুই এক কাজ কর ! এটার একটা ছবি তুলে নে ! বাড়িতে গিয়ে ভাল করে স্টাডি কর ! করে রাতে জানা ! সঞ্জয় তোকে অফিসিয়ালি ইনডিপেনডেন্ট ক্ৰিপ্টগ্রাফের হিসাবে এই প্রজেক্ট-এ অ্যাড করেছে ! আর আমার মনে হয়, তাতে আমাদের সবার লাভ !”

অজয় বললো – “সেকিরে ? সঞ্জয় তো বলেনি ! বা ! আমি তো কিছুতে সই করিনি ! “

মৌ বললো – “ভাই, এটা গভর্নমেন্ট অফিস ! এখানে, সব কিছু হতে একটু সময় লাগে ! তুই আগে চলে এসেছিস ! এটাই পার্থক্য ! “

অজয় বললো – “ছবি তো সামনের দিকে তুলবো ! কিন্তু, এটা কিন্তু আমার ক্রিপ্টোগ্রাফি লাগছে ! কিন্তু, তার তো একটা “কি” বা চাবি থাকবে ! কিন্তু, সেটা দেখছি না তো ! তোরা দেখেছিস ?”

মৌ বললো – “কৈ নাতো ! সেরকম কিছু চোখে পড়েনি তো ! “

উল্টে-পাল্টে দুজনে মিলে পান্ডুলিপিটা খুব কাছ থেকে দেখতে লাগলো ! হঠাৎ, একটা জিনিস দেখে অজয় থমকে দাড়িয়ে গেলো ! সূর্যের আলোয় তুলে ধরতে খুব আবছা কিছু একটা রয়েছে ! কিন্তু, ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস দিয়েও বোঝা যাচ্ছে না ! এরপর, হঠাৎ অজয় পান্ডুলিপিটা নাকের সামনে তুলে ধরতেই বুঝে গেলো – “মনে হচ্ছে পেঁয়াজের গন্ধ ! ওহ মাই ! আমি কি ঠিক ভাবছি !”

এইবারে, মৌপ্রিয়াও বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো – “ইনভিসিবল কালি? “

অজয় মাথা নেড়ে “হাঁ” বলে বুঝিয়ে দিলো ! মৌপ্ৰিয়া চট করে এক কনস্টেবলকে একটা মোমবাতি আর লাইটার আনতে বলে দিলো ! নিমেষের মধ্যে জিনিসপত্র এসে গেলো ! ইতিমিধ্যে, সঞ্জয়ও চলে এসেছে ! এসে, শুনে বলে বসলো – “আর ইউ ক্রেজি? আমি কিছুতেই এটা করতে দেব না ! কিছু ক্ষতি হয়ে গেলে ? “

মৌ বললো – “শোন সঞ্জয় ! আমিও দেখেছি পেছনে কি একটা আছে ! সেটা মোমবাতির আলোয় গরম না করলে দেখা যাবে না ! ভেবে দেখ ! নো রিস্ক – নো গেইন !”

সঞ্জয় বললো – “বেশ ! তবে, জাদুঘরের কর্মী হিসাবে আমি সেটা টেস্ট করবো ! তোরা কেও কিছু করবি না ! আমি বুঝলেই এই টেস্ট বন্ধ করে দেব !”

অজয় আর মৌ – দুজনেই রাজি হয়ে গেলো !

এরপর, মোমবাতিতে আগুন দিয়ে ধরিয়ে একটু দূর থেকে পাণ্ডুলিপির কোনটা ধরে রাখতেই লেখাটা ভেসে উঠলো ! পরিষ্কার করে দেখা গেলো – 

এটা দেখেই অজয় বলে উঠলো – “দারা ! আমি একটা ম্যাপ করে নি উইকি দেখে ! তারপর কি লেখা আছে আর কোনটা চাবি, সেগুলো বার কিরে নি ! এরপর, বাড়ি গিয়ে খোঁজার চেষ্টা করবো ! তবে, আমি নিশ্চিত এটা একটা সাইফার ! কিন্তু, ঠিক কি – সেটা বুঝতে সময় লাগবে !”

এইবার, অজয় প্রথমে চাবিটা বার করে নিলো উইকির গুপ্ত অক্ষরের পরিবর্তে ! সেই হিসাবে দেখতে গেলে নিচের পরবর্তী দুটো অক্ষর দেবনাগরিতে চিহ্নিত হয় –

তার মানে “c” বা “চ” আর “h” বা “এইচ” !

C আর H এ কি হতে পারে, সেটাই খোঁজার চেষ্টা করতে থাকলো অজয় ! হঠাৎ, মাথায় একটা বিদ্যুৎ খেলে গেলো ! সঞ্জয়কে জিজ্ঞাসা করলো – “চট করে বল – সেই সময় কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদ যে কিনা মালদার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত ! ওই ধরে নে তোদের বলে দেওয়া সময়ের সমসাময়িক ! অর্থাৎ, সতেরোশো থেকে আঠারোশোর মধ্যে ! আর, ইনি হয়তো ভারতীয় হবেন না ! কারণ, সেই সময়ে এই বিভাগে ভারতীয়র সংখ্যা খুব কমই থাকতো !”

শুনে সঞ্জয় ওর জাদুঘরের ল্যাপটপে বসে ওদের ইন্টারনাল ডাটাবেস চেক করে বললো – “ইউ মাস্ট বি কিডিং মি ! হেনরি ক্রেইটন (H C) ! ইনি জন্মসূত্রে স্কটিশ ! যিনি সতেরোশো ছিয়াশি সালে গৌড়ে আসেন নীল চাষের সুবাদে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মারফত ! ১৮০১ সালে গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে একটি মানচিত্র তৈরী করেন ! সুতরাং, গৌড়ের আবিষ্কারের পেছনে এনার গুরুত্ব অপরিসীম ! তাই, এ ক্ষেত্রে ওনার নাম-ই এখানে নেওয়া হয়েছে ! “

সঞ্জয় বললো – “কিন্তু, ওনার নামের এখানে গুরুত্বটা কি ? এটা কি শুধুই একটা চাবি নাকি এর পেছনে অন্য কিছুও আছে ?”

অজয় বললো – “আমার পঞ্চম ইন্দ্রিয় বলছে ! ব্যাপারটা এতো সোজা নয় ! কিছু একটা বিশেষ ব্যাখ্যা আছে ! একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে ! আপাতত, আমি একটু একা ভাববো ! “

এই বলে অজয় লালবাজার থেকে ল্যাপটপ নিয়ে বেরিয়ে এলো ! মৌ এসে বললো – “দারা ! তোকে আমি ছেড়ে দিয়ে আসি ! “

অজয় বললো – “আরে, ঠিক আছে ! আমি চলে যেতে পারবো !”

মৌ বললো – “ও হচ্ছে না ! এতদিন পর পেয়েছি ! তোকে এতো সহজে ছেড়ে দেব নাকি ?”

অজয় বললো – “আর, তোর অফিস ?”

মৌ বললো – “বসকে বলে এসেছি কালিকাপুরে একটা কাজের ফলো-আপ আছে ! তাই যাচ্ছি !”

অজয় বললো – “ইস ! জাতা শুরু করেছে মেয়েটা ! ঠিক আছে চল !”

মৌ একগাল হেসে জিপে উঠে গেলো অজয়কে পাশে বসিয়ে ! গন্তব্যস্তল – অজয়ের বাড়ি !

অজয়ের কিন্তু মনে-মনে বেশ ভালোই লাগছে ! আর মৌ এতবড়ো পোস্টে কাজ করলেও, এখনো ওর মধ্যে ওই আগের চুলবুলি ব্যাপারটা কিন্তু আছে ! খুব একটা পাল্টায়নি !

যেতে-যেতে মৌ ওর পুলিশ একাডেমির সব কীর্তি বলতে থাকলো ! অজয়ের বেশ ভালোই লাগলো সেই সব খবর শুনতে ! ঠিক দুপুর দুটো নাগাদ ওরা দুজনে অজয়ের বাড়ি পৌছালো !

অজয়ের মা মৌকে দেখে বললো – “ওমা মৌ ! কত্তদিন পর দেখছি তোকে ! কেন আশীষ না বাবু ? এই কাকিমার কথা কি মনে পরে নারে শোনা ? আর কত্ত রোগা হয়ে গেছিস? কিন্তু, তাও ভীষণ মিষ্টি লাগছে !”

এইবারে, শুধু অজয় নয়, মৌও একটু লজ্জা পেয়ে গেলো ! গিয়ে ঢিপ করে কাকিমার পায়ে একটা প্রণাম ঠুকে দিলো ! কাকু দেখে বললো – “দেখো মেয়ের কান্ড ! ওরে, তুই এখন তো ডিউটিতে ! কোনো প্রণামের দরকার নেই ! ওই পোশাকের না হলে অসম্মান হবে ! তবে, দুপুরে এসেছিস ! খেয়ে অবশ্যই জাবি কিন্তু !”

মৌ বললো – “এমা কাকু ! আমি তো তোমাদের সাথে দেখাই করতে এলাম ! ছুটির দিনে এসে খেয়ে যাবো !”

অজয়ের মা – মৌয়ের হাত দুটো ধরে বললো – “বাবু ! দু-মুঠো খেয়ে যা ! নাহলে মনটা ভালো লাগবে না !”

এবারে যেন মৌ আর কথা ফেলতে পারলো না ! বললো – “আচ্ছা কাকিমা ! তুমি অমনভাবে বলো না ! আমি খেয়েই যাবো ! হয়েছে ? এবারে হ্যাপি তো ?”

কাকিমা একগাল হেসে বললো – “ঠিক আছে ! তুই অজয়ের ঘরে গিয়ে একটু বস ! আমি খাবার বেড়ে তোদেরকে ডাকছি !” এই বলে কাকিমা রান্নাঘরে ঢুকে গেলো !

অজয় হেসে বললো – “আয় ! আমার ঘরে ! একটু আড্ডা মারি !”

দুপুরে আধঘন্টা আড্ডা মেরে খেয়ে মৌ জিপ নিয়ে বেরিয়ে গেলো ! এইবারে, অজয় একটু সময় পেয়েছে ! আবার, ল্যাপটপ নিয়ে অজয় বসলো !

পঞ্চম পর্ব :

খুব ধীরে-সুস্থে ভালো করে পাণ্ডুলিপির ছবিগুলো দেখতে লাগল ! হঠাৎ, মনে হলো হয়তো নামটা দুটো জিনিসকে বোঝায় !

এক. খুব সম্ভবত, হেনরি চাননি যে এই তত্থ বাকি ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকেরা জানুক !

দুই. এটা একটা বিশেষ সময়ের কথা বলা হচ্ছে !

তার মানে, ওই সময়ের সাইফারের যা প্রচলন ছিল ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের মনে, খুব সম্ভবত এটাও সেইরকমই কোনো মডেল দিয়ে করা হয়েছে ! এইবার, হঠাৎ চোখে পড়লো – মনোআলফাবেটিক সাইফার ! এই ক্ষেত্রে, যেকোনো একটা অক্ষর হেনরির নামের আদ্যাক্ষর এর অবস্থান দিয়ে সংশ্লিষ্ট অক্ষরটা যা পাণ্ডুলিপিতে আছে, তাকে চিহ্নিত করতে হবে !

এরই মধ্যে অজয় এর বোন রুমা এসে হাজির ! ও বললো – “কি করছিস রে দাদাভাই ?”

অজয় বললো – “যা এখান থেকে ! আমায় জ্বালাস না ! একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে আছি !”

রুমা বললো – ” বল-ই না ! শুনি একটু ! তুই ভুলে যাচ্ছিস আমি কম্পিউটার নিয়ে ব্যাচেলর করছি ! হতেও তো পারে, আমিও যদি কিছু বলতে পারি – যেটা হয়তো তুই কোনোভাবে মিস করে গেছিস ! এটা তো জানিস একটা চোখের পরিবর্তে দুটো চোখ সব-সময় ভালো ! “

অজয় এইবার কথাটা শুনে আর না করতে পারলো না ! মনে-মনে ভাবলো – “ঠিকই তো ! আমি-তো ওকে এখনো স্কুলে পরে ভাবছি ! অথচ, ওতো কলেজ-এ পড়ছে !”

এই ভেবে অজয় বললো – “বেশ ! তাহলে তুই বল এনক্রিপশন আর সাইফার সম্পর্কে কি জানিস ?” 

রুমা বললো – “খুব সামান্য ! তবে এই জানি আগেকার দিনে এই পদ্ধতিতে গুপ্ত সংবাদ আদান-প্রদান হতো চরেদের মধ্যে ! আর এই সংবাদ পড়ার একটা বিশেষ প্রক্রিয়া আছে ! আপাতদৃষ্টিতে লেখাগুলোর কোনো মানে থাকে না ! কিন্তু, একটা চাবি যা কিনা কোনো শব্দ, তার সাহায্য নিয়ে সেইসব তথ্যগুলোকে অন্যপ্রান্তে পড়া যায় ! কি ঠিক বললাম কি ?” 

এইবার অজয় সত্যি তাজ্জব হয়ে হেসে ফেলে বললো – “একশোয় একশো !” 

অজয় বললো – “ঠিক আছে ! এইবারে, এই দুটো পাণ্ডুলিপি দেখ ! আসলটা আজ থেকে প্রায় নশো-বছর আগের ! আর, অন্যটা এরই আদলে করা একটা প্রতিকৃতি, যেখানে একই হরফ ব্যবহার করা হলেও ওই যুগের কথার সাথে কোনো মিল নেই ! অনেকটাই হিজিবিজি এর মতো ! কিন্তু, এই দ্বিতীয় পান্ডুলিপিটা প্রথমটার আদলের হলেও প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো ! এবং, খুব সম্ভবত একজন বিখ্যাত মানুষ এই সাংকেতিক পান্ডুলিপিটা লিখে গেছেন ! তাই, আমরা একেও উপেক্ষা করতে পারছি না !”

আরো বললো – “এখন, সেই যুগে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যে ধরণের সাইফার ব্যবহার করা হতো, তাদের মধ্যে কাছাকাছি হচ্ছে মনোআলফাবেটিক ! যেখানে, প্রতিটা অক্ষর একটা নম্বর দিয়ে বোঝানো হতো ! কিন্তু, এখানে দুটো গ্রুপ ব্যবহার করা হয়েছে ! তাই ব্যাপারটা একটু আলাদা হয়তো !” 

রুমা বললো – “কিরকম ব্যাপারটা ?”
অজয় বললো – “বেশ ! এটা একটু সহজে ব্যাখ্যা করা যাক ! ভালো করে নিচের ছবিটা দেখ ! লক্ষ্য কর, আমাদের পাণ্ডুলিপিতে সি আর এইচ এইদুটো অক্ষর পাওয়া গেছে ! আমি যদি প্রতিটা অক্ষরের একটা সংখ্যা দি, তাহলে সেই হিসাবে দেখতে গেলে সি এর ভ্যালু হবে নম্বর ছয়, আর এইচ এর ভ্যালু হবে নম্বর তেত্রিশ ! এটুকু বুঝলি ? “

রুমা বললো – “জলের মতো ! তারপর ?”

অজয় বললো – “গুড ! এবারে আমরা পাণ্ডুলিপিটার প্রথম অক্ষর থেকে শুরু করবো পড়া ! প্রথম অক্ষরটা ছয় নম্বর হবে ! পরের অক্ষরটা হয়তো তেত্রিশটা অক্ষরের পরে হবে ! দেখতো, কোনো অক্ষরগুলোর মানে দাঁড়াচ্ছে কিনা ? “

রুমা বললো – “তাহলে দাদাভাই তোমায় হেল্প করি ?”

অজয় বললো – “হুম ! কর দেখি ! আমারও একটু সুবিধা হবে ! বাকি জিনিসগুলো আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারবো এই সাহায্যটা পেলে !”

তার কিছুক্ষন পর রুমা বললো – “নারে দাদা ! কোনো মানে দাঁড়াচ্ছে না ! কিছু একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে ! “

অজয় বললো – “হুম ! আমার একটা সন্দেহ লাগছে ! ওই তেত্রিশ নম্বরটা দেখে ! দারা, একটু ভাবতে দে !”

তারপর অজয় বললো – “ওই দারা-দারা ! একটা খটকা লাগছে ! মনে হচ্ছে – আমি ধরতে পারছি ! কিছুই না ! একটা গেস ! করে দেখতো !”

অজয় বললো – “এবারে আমরা পাণ্ডুলিপিটার প্রথম অক্ষর থেকে শুরু করবো পড়া ! প্রতি ছ-নম্বর অক্ষর পেলে সেটা আমরা খাতায় লিখবো ! আর, এইভাবে, পড়তে-পড়তে শেষ অব্দি যাবো ! সব মিলিয়ে তেত্রিশ বারের বেশি পড়ার দরকার নেই বলেই মনে হচ্ছে ! বুঝলি ?”

রুমা খুব আগ্রহের সঙ্গে কাছে চেয়ার নিয়ে এসে বললো – “দারা ! দেখি !”

অজয় বললো – “কর ! কিন্তু, খুব ধীরে-সুস্থে করতে হবে ! তাড়াহুড়ো করলে চলবে না ! আর, তাছাড়া আমি এও জানিনা এতে কাজ হবে কিনা ! নাও হতে পারে ! শুধু, একটাই ভরসা ! যে সময়ে এটা করা হয়েছে, সেই সময়ের সাইফার গুলো আমাদের এখন জানা ! তাই আশা করছি খুব বেশি সময় লাগবে না !”

রুমা বললো – “তাহলে, আর দেরি কেন ? লেটস স্টার্ট !”

অজয় বললো – “প্রথমে পাণ্ডুলিপিটার একটা প্রিন্ট-আউট নিয়ে এসে স্কেল দিয়ে খোপ-খোপ করে কেটে নিতে পারিস যদি তোর বুঝতে অসুবিধা হয় তো ?”

রুমা বললো – “তার দরকার নেই ! আমি ছ-টা করে অক্ষর গুনে থামছি ! তুমি, সেটা দেখে উইকির থেকে বাংলা বা হিন্দি শব্দটা বার করো ! মানে আমাদের ভাষায় পরিবর্তন করলে বুঝতে পারবো তো ?”

অজয় বললো – “হাঁ ! এই হেনরি ক্রেইটন ভারতবর্ষের অনেক ভাষায় কথা বলতে পারতেন ! তাই, এই ধাঁধা হয় ইংরেজি বা হিন্দি বা বাংলাতেই থাকবে আশা করি ! নে শুরু কর !”

বলার সঙ্গে-সঙ্গে ওর বোন গুনে প্রথম অক্ষরটায় থেমে একটা গোল দাগ কাটলো ! আর, সঙ্গে- সঙ্গে অজয় উইকি থেকে তার প্রথম বাংলা বা হিন্দি অক্ষরটা লিখতে থাকলো !

এইবার, অজয় বললো – “দারা ! আগে একটু দেখে নি – আদেও কিছু মানে দাঁড়াচ্ছে কিনা ! নাহলে, শুধু শুধু করে লাভ নেই !”

এতটা অব্দি দেখে অজয়ের চোখ গুলো বড়ো হয়ে উঠলো ! চিৎকার করে বলে উঠলো – “বোন শিগগির গুগলে একবার সার্চ করে দেখতো ?”

রুমা বলে উঠলো – “এতোটায়, ঠিক কি পেয়েছো ?”

অজয় গভীর নিঃস্বাস ফেলে বললো – ” পা হা র পু র   বু দ্ধ ” !

রুমা চট করে গুগলে একটা সার্চ করতেই চমকে গেলো ! ইন্টারনেট এ দেখাচ্ছে ওই নামের একটা ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান আছে “পাহাড়পুর বুদ্ধিস্ট মনাস্টেরী“, যা বর্তমান বাংলাদেশে অবস্থিত ! এটা অজয় জানে যে দেশভাগের সময় কিছুটা অংশ বাংলাদেশেও পরে !

অজয় মনে-মনে ভাবতে শুরু করলো ! তাহলে কি বাংলাদেশেই রাখা আছে বর্তমান বিপুল ধন-সম্পদ !

পাণ্ডুলিপির বাকি পাতাগুলো ঘেটে অজয় মোটামোটি নিশ্চিত হয়ে গেলো – এ পাল বংশের বহুমূল্য সম্পদ লুকিয়ে রাখার কথা বলা হয়েছে !

শেষ পর্যন্ত অজয় সব বুঝে সঞ্জয় আর মৌকে আলাদা করে গ্রুপ তৈরী করে ওদেরকে জানালো – “গ্রুপ ভিডিও কলের দরকার আছে ! এমন, কিছু এক্সসাইটিং জিনিস পাওয়া গেছে ! যেটা তোদেরকে এক্ষুনি জানাতে হবে !”

মেসেজ ডেলিভার হওয়ার এক মিনিটের মধ্যে দুজনেই টেক্সট এসে উপস্থিত – “আমরা এখন ফাঁকা আছি !”

এইবার ও রুমাকে ঘর থেকে যেতে বলে – অজয় দরজা বন্ধ করে যা পেয়েছে, প্রায় সব কিছু ডিটেইলে ছবিসহ দেখালো ! সত্যি কথা বলতে কি ফোনের ঐপারে দুইজন প্রায় কথা হারিয়ে ফেলেছে ! কি সাংঘাতিক ব্যাপার ! কিন্তু, তার সঙ্গে এও ভাবতে হচ্ছে এর জন্য তো তাহলে আমাদের পড়শী দেশে যেতে হবে – যদি আর কোনো “ক্লু” বা “সংকেত” থাকে তো ! আর, যদি কিছু ঐখানেই বেরোয় তাহলে সেই ধনসম্ভার আজকের ভারতে আসবে না ! অবশ্য, এটা ঠিক অজয় ঐভাবে দেখে না ! ধনসম্পদ মাটিতে থেকে নষ্ট হওয়ার পরিবর্তে তা যে দেশেরই হোক, কাজে দেয় তাহলে তার থেকে ভালো আর কিছু হয় না !

অজয় সেই ভাবেই বললো – “দেখ আর কেও যাক বা না যাক, আমি ওই দেশে ওই জায়গায় যেতে চাই ! যদি ধনসম্পদ ওই দেশেই থাকে, তো ওখানকার সরকারকে জানিয়ে ওদের হাথে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো ! আর, নাহলে তোদের সাথে কাজ করে খোঁজার চেষ্টা করবো এদেশে হলে ! আর তাছাড়া আমার যাওয়ার কোনো অসুবিধা হবে না ! গত বছরই শৈবালের সাথে ওর আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের ভিসা করেছিলাম ! তাই, আমার যেতে অসুবিধা নেই !”

এই কথা শুনে সঞ্জয় বললো – “দারা ! একটু ভাবতে দে ! তুই যদি অফিসিয়ালি যাস, আর যেভাবে খবর ছড়িয়ে যাচ্ছে – তুই বাংলাদেশে গিয়ে কিছুই হয়তো খুঁজে পাবি না ! আর, তাছাড়া স্থানীয় লোকেরা অন্যরকম ভেবে প্রব্লেমও করতে পারে ! তার থেকে তুই আগে পার্সোনালি যা ! যদি দেখিস আমাদের সরকারের দরকার আছে ! আমাকে বলিস ! আমি এখান থেকে সব ব্যবস্থা করে দেব ! কিন্তু, তোর যদি ওই দেশের সরকারের কোনো দরকার লাগে তো তখনই বলিস ?”

অজয় বললো – “তার চিন্তা নেই ! শৈবালের পিসির ছেলে স্থানীয় সরকারি অফিসে বেশ উচ্চপদস্থকর্মী ! আমার সঙ্গে আলাপও হয়েছিল ! আর, তাছাড়া ওর ভাগ্নাকে আমি খুব হেল্প করেছি ক্যালিফোর্নিয়াতে সেটলড হতে ! তাই আশা করি – ওর থেকে ভালো সাপোর্ট পাবো !”

সঞ্জয় আর মৌ শুনে এক কথায় বলে উঠলো – “ব্রাভো জেনিয়াস ! এগিয়ে যাও ! “

মৌ বললো – “তাহলে শৈবালকেও এই কলটায় ঢোকা ! ওকেও তো জানতে হবে ! অন্তত, কিছুটা ! মানে কেন যাচ্ছে ! কি বলিস তোরা ?”

সঞ্জয় বললো – “হাঁ ! সে যতটুকু বলার দরকার, এই মুহূর্তে আমি ততটুকুই বলবো !”

এই বলে সবাই মিলে শৈবালকে ভিডিও কলে অ্যাড করে কিছুটা ঘটনা খুলে বললো ! শৈবাল তো এক পায়ে খাড়া ! আরো যখন শুনেছে ওদের যাতায়াতের খরচটা গভর্নমেন্ট পরে দিয়ে দেবে !

সেই মতো দিন-খন ঠিক হয়ে গেলো !

ষষ্ঠ পর্ব :
ঠিক করা হলো কলকাতা থেকে মালদা হয়ে সেখান থেকে বাংলাদেশে ঢোকা হবে ! কারণ, পাহাড়পুর এলাকা মালদার থেকে কাছে ! দূরত্ব হিসাবে কম হলেও রাস্তার আঁকা-বাঁকা হওয়ার জন্য সাড়ে তিন-ঘন্টা লাগে পৌঁছাতে !

সেই প্ল্যান মতো দিন এসে উপস্থিত ! অজয় আর শৈবাল বাড়িতে জানিয়ে মালদার দিকে রওয়ানা দিলো ! মালদা আর গৌড় অব্দি সঞ্জয়ও থাকবে ! দুটো কারণে ! এই পথে কিছু দরকার পড়লে ও সব থেকে ভালো সাহায্য করতে পারবে ! আর, তাছাড়া সঞ্জয় একবার যে মন্দির থেকে পান্ডুলিপিটা উদ্ধার হয়, সেটাও অজয়কে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবে ! কে বলতে পারে, যে ওই মন্দিরের ভেতরই বাকিসব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে !

অজয় সঙ্গে ওর ল্যাপটপটা নিয়ে নিয়েছে ! যদি কোনো কাজে লাগে তো ! কারণ, ওর ল্যাপটপে নানারকম লেটেস্ট প্রেডিকশন করার সফটওয়্যার আর প্রোগ্রামিং আছে যা ও প্রজেক্টে করেছিল ! কাজেই, দরকার পড়লে সেগুলোকেও কাজে লাগানো যেতেই পারে ! আর, তাছাড়া বিভিন্ন ডকুমেন্ট আদান-প্রদান ও ইমেইল বা ভিডিও কলের জন্যও ল্যাপটপটা লাগবে !

ঠিক সকাল সাড়ে দশটায় ট্রেনটা ছাড়লো ! স্টেশনে প্রায় সবাই এসেছিলো দেখা করতে ! মৌয়ের কোনো স্পেশাল কাজ পরে গেছে ! তাই ও আসতে পারেনি !

ওরা আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে পড়লো ! বিকেল পাঁচটার মধ্যে ওরা মালদায় গিয়ে হাজির ! ট্রেন একটু লেট ছিল ! কিন্তু, শেষের দিকটায় খুব ভালো টেনে দিয়েছে !

স্টেশনে সব মালপত্র নামিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখে সরকারি গাড়ি ওদের জন্য অপেক্ষা করছে ! সঙ্গে স্পেশাল পুলিশ প্রটেকশন ! আর, পুলিশের জিপের ড্রাইভারের পাশেই বসে আছে মৌ ! অবশ্য ডিউটিতে ! কিন্তু, কেন জানিনা প্রথমবারের জন্য অজয়ের মনে ভীষণ আনন্দ হলো ! খুব ভালো লাগলো ! ওকে গিয়ে প্রায় হাত দুটো ধরে আলতো করে হাথে একটা টোকা মেরে বললো – “কিরে ? তুই এখানে ? খুব আনন্দ লাগছে ! “

আর মৌও কথাটা শুনে হেসে বললো – ” যাক ! তোর তাহলে আমায় দেখে আনন্দ লাগে ! কোনোদিনতো সেই শব্দ শুনিনি ! এতবছর অপেক্ষা করার তাহলে আজ দামটা পেলাম ! তবে, আমার ভীষণ ভালো লাগছে তুই খুশি হওয়াতে ! কিন্তু, যতক্ষণ না তোরা ফিরছিস, আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে ! পৌঁছে অতি অবশ্যই টেক্সট করবি ! কোনো কিছু বিপদ হলে একবারের জন্য কিন্তু তোরা ভাববি না ! কথাটা মনে রাখিস প্লিজ !”

আজ এই কথাগুলো যেন যাওয়ার আগের মুহূর্তগুলোকে একদিকে ভীষণ আনন্দের আর অন্যদিকে কেমন একটা যেন দুঃখ অজয়ের মনের মধ্যে এনে দিলো !

সঞ্জয় বললো – “নে চল ! এখনো মন্দির দেখাতে হবে ! “

এই বলে সবাই মিলে রওয়ানা দিলো ! প্রথমে গিয়ে পৌছালো – “চামচিকা মন্দির” ! এখানেই নাকি কোনের একটা ছোট্ট গর্তের মধ্যে ওই পাণ্ডুলিপি লোকানো ছিল ! অজয় দেখে বললো – “হুম ! দেখলাম ! না, সেরকম আর কিছু দেখছি না এই মন্দিরে ! মনে হচ্ছে এখানে খুব রান্ডাম রাখা হয়েছে ! কিন্তু, তার মানে এটা নয় যে লোকানো সম্পদ এর কাছেই আছে !”

এরপর, সঞ্জয় আর মৌ আরেকটা আলাদা গাড়িতে করে সব দরকারি কাগজপত্র দিয়ে বর্ডারের দিকে এগিয়ে চললো !

ঘন্টাখানেক চলার পর বর্ডারে গিয়ে পৌছালো ! সঞ্জয় বললো – “তোরা এইবারে ঠিক তিনদিন থাকবি ! কোনোরকম রুটের বাইরে জাবি না ! আমি বললে জাবি ! আর, আমরা বাংলাদেশের পুরাতত্ববিদের সাথে কথা বলছি ওই দেশের সরকার ছাড়াও ! কোনো কিছু আপডেট পেলেই জানাচ্ছি ! তবেই তোরা রুটের বাইরে যেতে পারবি ! তার আগে নয় !”

শৈবাল বললো – “ওই পারে আমার দাদা চলে এসে অপেক্ষা করছে ! ইমিগ্রেশন হয়ে গেলেই আড়াই ঘন্টার দৌড় ! তারপর, পিসির বাড়ি !”

সঞ্জয় বললো – “বেস্ট অফ লাক ব্রাদার্স ! সাবধানে সব কিছু করে তোদেরকে এপারে দেখতে চাই ! আশা করি কোনো ঝামেলা হবে না !”

মৌ শৈবালকে বললো – “সাবধানে যাস ! আর, ওকে একটু দেখিস !”

শৈবাল বললো – “চাপ নিওনা বন্ধু ! ওকে না ফেরাতে পারলে কলকাতা পুলিশ আমার পেছনে পরে যাবে !” – বলে মুচকি হেসে চলে গেলো !

অজয় এতক্ষন খানিকটা ঘোরের মধ্যে শুনে গেছে ! ও এরপর বললো – “জানিনা এতদিন আমি মনে হয় বুঝতে পারিনি ! আজ হয়তো মনে হচ্ছে দেরি করে ফেললাম ! কিন্তু, যাই হোক, বুঝতে হয়তো পারলাম অবশেষে !”

এরপর মৌ ওকে একটা হাগ করে বললো – “সাবধানে সব কিছু করে ফিরে আয় ! আমি অপেক্ষা করবো !”

অজয় আর শৈবাল – “আচ্ছা ঠিক আছে বলে বেরিয়ে গেলো ! “

সপ্তম পর্ব :
দেখতে-দেখতে ওরা বর্ডার ক্রস করে অফিসের ভেতরে ঢুকে গেলো ! প্রায় কুড়ি মিনিট পর একটা বাংলাদেশের নম্বর থেকে কল এলো ! শৈবালের !

“আমাদের ইমিগ্র্যাশন হয়ে গেছে ! আমরা এখন পিস্ততো ভাইয়ের সাথে পিসির বাড়ির দিকে ছুটে চলেছি ! ” – বললো শৈবাল !

খবরটা পেয়ে মৌ আর সঞ্জয় বর্ডার থেকে সরকারি গাড়িতে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলো ! ওদের ফিরতে প্রায় ভোর হয়ে যাবে !

ওদের মাঝপথে অজয়ের টেক্সট এলো মৌয়ের মোবাইলে – “ঘরে ঢুকে গেছি ! সাবধানে যাস ! আর, বাড়ি পৌঁছে একটা টেক্সট করে দিস তোরা !”

টেক্সটা পেয়ে একটু নিশ্চিন্ত হলো সঞ্জয় আর মৌ !

ওদের ফিরতে-ফিরতে পরের দিন ভোর পাঁচটা হয়ে গেলো !

মৌ আর সঞ্জয়ও ঘরে ঢুকে টেক্সট করে দিলো ! পরেরদিন ওরা দেরি করে অফিস যাবে !

ওদিন সকাল আটটায় শৈবাল আর অজয় শুরু করলো রওয়ানা ! শৈবালের পিসির বাড়ি থেকে সোমাপুরা মহাবিহার যেতে লাগবে ঘন্টাখানেক !

ওরা কথামতো যাওয়ার আপডেট গ্রুপে দিয়ে এগিয়ে চললো ! শৈবাল ওর ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে তৈরী হতে থাকলো !

আজ আবার শৈবালের পিসতুতো দাদা হারুন একটা দ্রোনও নিয়ে এসেছে ! শৈবাল আর অজয় অবশ্য কিছু বলেনি ! শুধু বলেছে যে “তোমার তোলা দ্রোন-শট যদি আমাদের সাথে শেয়ার করো তাহলে আমি কলকাতার বন্ধুদেরকে দেখাবো !”

তাতে এক কথায়ে রাজি হয়ে গেছে হারুন ! সেটা অজয়দের এই অনুসন্ধানে খুব সুবিধা করে দেবে ! পথের মধ্যে ওরা মাঝখানে এক ফাঁকা চায়ের দোকানে এক পেয়ালা চা আর পাউরুটি টোস্ট খেয়ে আবার দৌড় লাগলো !

তারও প্রায় ঘন্টাখানেক পরে ওরা পৌছালো ! কি সুন্দর এই জায়গাটা ! দেখে ইনকাদের পিরামিডের মতো অনেকটা দেখতে ! খানিকটা সাঁচির স্তূপেরও মিল আছে !

জায়গাটা বেশ অনেকটা এলাকা জুড়ে ! কিন্তু, জমি থেকে তার গুরুত্বটা এত ভালো বোঝা যাচ্ছে না ! হারুন এবারে দ্রোন চালু করে দিলো অথরিটির সাথে কথা বলে ! মিনিট পনেরো ও ওরাল ! তার মধ্যে অজয় আর শৈবাল মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার বহু চরিত্র দেখতে পেলো অষ্টম ও নবম শতকের !

ঘুরতে-ঘুরতে শৈবাল প্রায় প্রত্যেকটা এই মূর্তির ছবি তুলতে থাকলো ! কারণ, অজয় বলে দিয়েছে ! হঠাৎ, ওর চোখে এমন কয়েকটা “টেরাকোটার-প্লেট” চোখে পড়লো যার সাথে বাকি প্লেটগুলোর কোনো মিল নেই !

লোকাল এক গাইডকে একটু টাকা দিতে জানা গেলো আঠারোশো শতকে কোনো এক সাহেব নাকি এই প্লেটগুলো লাগিয়ে দিয়েছিলেন ভেঙে যাওয়া টালির বদলে !

শুনেই ওরা দুজনে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ভাল করে প্রত্যেকটা প্লেটের ছবি তুলে নিলো !

তবে, প্লেটগুলোর একটা বিশেষত্ব চোখে পড়ার মতো ! পাথরগুলো পুরোনো হলেও লেখাগুলো মনে হয় বেশিদিনের পুরোনো নয় ! অজয় সামনে গাইডকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো – “আচ্ছা এই প্লেটগুলোতে যে লেখা আছে সেগুলো কতদিন ধরে আছে ? লেখার গঠন দেখে তো বেশি পুরোনো লাগছে না !” 

গাইড শুনে হেসে জানালো – “জি ! ঠিকই ধরেছেন ! গতবারের ঝরে এই অঞ্চলের বড়ো ক্ষতি হয় ! তাতে, এই ফলকগুলোরও হয় ! স্থানীয় প্রশাসন তার পরিবর্তে ওই একই পাথরে আগের লেখাগুলি লিখে এখানে আবার আটকে দেন ! আগে, এই লেখাগুলো পাথরের ওপর খোদাই ছিল ! এখন, ওই একই পাথরে রং করে ওই কথাগুলি লিখে দেওয়া হয়েছে !”

অজয় বললো – “এক লেখা বুঝছেন কি করে ? কেও তো কোনো একটা শব্দ বদলেও তো দিতে পারে ? “

গাইড হেসে বললেন – “জি ! সেটা হবে না ! ছোটবেলা থেকে এই লেখা আমাদের মুখস্থ ! একটাও শব্দ পাল্টে গেলে আমাদের চোখে পরে যেত !” – এই বলে সে গড়গড় করে লেখাগুলো বলে গেলো ! আর অজয়ও প্রতিটা শব্দ মিলিয়ে নিলো ! দেখলো, না একই আছে ! কোনো শব্দ বাদ বা পরিবর্তন বা সংযোজন করা হয়নি ! 

মনে-মনে ঠিক করলো বাড়ি ফিরে অনেক কিছু স্টাডি করার আছে ! অঙ্কে বরাবরই ভালো হলেও, ধাঁধার ক্ষেত্রে কোনোদিন সেইভাবে মাথা খাটায় নি ! এখন, ঐখানে ভাবতে হবে ! 

ওখানে, ওরা আরো ঘন্টাখানেক ঘুরে, ছবি তুলে বাড়ির জন্য রওয়ানা হলো ! 

বাড়ি ফিরে রাতের খাবার খেয়ে শৈবাল আর অজয় সব ছবি গুলো নিয়ে বসলো ! কিছুক্ষন আগে শৈবালের ভাই ভিডিওটা এডিটিং করে ইউটুবে তুলে দিয়ে হোয়াটস্যাপে লিংক শেয়ার করে দিয়েছে ! 

অজয় বললো – “দেখ ! বাকি সব প্লেটগুলো সেই সময়ের আর এই দুটো প্লেট যেহেতু ভেঙে গিয়ে পাল্টে দেওয়া হয়েছে, তাই ঠিক বোঝা যাচ্ছে না – এগুলো অন্তত দুশো বছর ধরে ছিল কিনা ! তবে, যেভাবে আমাদের গাইড মুখস্থ বলে গেলো ! সেটা, ছোটবেলা থেকে না দেখলে নেহাত কাজের খাতিরে ঐভাবে মুখস্থ আওড়ানো সম্ভব নয় ! তাই, ধরে নিচ্ছি ও সত্যি কথাই বলছিলো ! কি বলিস ?”

শৈবাল বললো – “তোকে এখানে আমি কিছুটা help করতে পারি ! বছর পাঁচেক আগে যখন প্রথম এসেছিলাম, তখন এই ছড়াটা আমার বেশ মজা লাগে ! আমি সেই লেখাটা ফেসবুকে পোস্টও করেছিলাম ! অবশ্য, আমার নিজের হাথের লেখা ! আর, আমি যার থেকে টুকে লিখেছিলাম – সেটা আসল পাথরই ছিল ! তখনও ভাঙ্গেনি !”

অজয় উচ্ছাসের সাথে বললো – “করেছিস কি ? তাহলে তো কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে – লেখার বিশ্বাস যোগ্যতা নিয়ে !”

এই বলে শৈবাল খুঁজে-খুঁজে পুরোনো পোস্টটা অজয়কে দেখাল ! এই প্রমাণটাই অজয় খুঁজছিলো ! অন্তত, এখন চোখ বন্ধ করে এই শব্দের সত্যতা মেনে নিতে আর অসুবিধা হবে না ! 
অজয় বললো – “প্লেটগুলোর ছবি আবার বার কর ! দেখি এবারে ভালো করে ! “

দুটো প্লেট ! দুটো আলাদা ধাঁধা ! এইমুহূর্তে, অজয় ঠিক বুঝতে পারছে না – দুটো সম্পূর্ণ আলাদা না একই ধাঁধার দুটো অংশ !

অজয় বললো – “এই প্রথমবার আমার মনে হয় চোখে রাজহংস কোনো ধাঁধার মধ্যে দেখলাম ! যাই হোক, এই প্রথম দুটো লাইনের মানেটা কি ?”

মনে-মনে বিড়বিড় করতে থাকলো ! “শূন্য ডগায় বা কেন বলেছে ?” – আরো বললো অজয় !

“তবে এটা ঠিক, এই লাইন দুটোয় তোর কোনদিকে লুকোনো আছে, তা বলেছে বলে মনে হচ্ছে ! ” – বললো অজয় !

শৈবাল বললো – “তুই শিউর ?”

অজয় বললো – “হাঁ ! ওই ‘দিশা দেখায়’ শব্দগুলো দেখে তাই মনে হচ্ছে !”

শৈবাল বললো – “রাজহংস মানে তো পাখি ! পাখি দেখবে কিছু একটা ! কিন্তু, কি দেখবে ?”

অজয়ের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো – “বললো তোর ভাইয়ের দ্রোন ভিডিও ! শিগগির চালা ! “

এইবার, শৈবালেরও আর বুঝতে বেশি সময় লাগলো না ! কেন বলেছে ! অর্থাৎ, ওপর থেকে এই জায়গাটা দেখে কিছু বার করতে হবে ! কিছু, “ক্লু” রাখা আছে !

ইউটুবে খুলে তো দুজনের চক্ষু চড়কগাছ ! এতো স্পেশাল ইফেক্ট মেরেছে ওর ভাই ! যে ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না ! তার ওপর ইন্টারনেটও ভীষণ স্লো !

অজয় বললো – “এক কাজ কর ! গুগল ম্যাপ খোল ! ওখানে গিয়ে স্যাটালাইট ভিউতে এই জায়গাটা সার্চ কর ! “

নিমেষের মধ্যে ছবি পেয়ে গেলো যা ওরা চাইছিলো ! খুব ভাল না হলেও ওদের কাজের জন্য চলে যাবে !

ছবিটার চারটে ভাগ করে অজয় দিক গুলো লিখে রাখলো – উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব আর পশ্চিম ! যাতে, বুঝতে সুবিধা হয় ! আর, গুগল ম্যাপ – এ ব্যাপারে খুব বিশ্বাসযোগ্য !

এইবারে, অজয় বললো – “লাইনগুলো দেখ ! কি বলেছে ! ওপর থেকে দেখতে বলেছে ! আর, বলেছে – শূন্য ডগায় দিশা দেখায় ! দেখতো ওপর থেকে কোথাও ডগা নেই এমন জায়গা কিছু আছে কিনা ?”

শৈবাল বললো – “ডগা নেই মানে ?”

অজয় বললো – “সেটা আমি জানিনা ! যেটকু বুঝতে পারছি বাকি তিনটে দিকের সাথে এই দিকের কিছু একটা পার্থক্য আছে !”

এবারে, দুজনেই খুব ভালো করে ছবিটা দেখতে শুরু করলো !

এরপর, শৈবাল বললো – “উত্তরে একটা লেজ মতো কি একটা আছে ! কাজেই ওটা বাদ !”

অজয় বললো – “কি বল্লি ?”

শৈবাল বললো – “আরে, দেখছিস না ? একটা লাইন মতো বেরিয়ে গেছে !”

অজয় বললো – “জেনিয়াস ! তুই একদম ঠিক ধরেছিস ! আমাদের লেজ না দেখলেও চলবে ! শুধু আনামলিটা দেখতে হবে ! উত্তরদিক বাদ ! পূর্বদিকও ! আর, দক্ষিণও ! তার মানে পশ্চিম !”

শৈবাল বললো – “কিন্তু, দক্ষিণে তো কোনো ল্যাজ নেইতো ?”

অজয় বললো – “না ! দরকার নেই ! তাই তো তোকে বললাম ! আমার চরিত্রগত পার্থক্য দরকার ! দক্ষিণে দেখ একটা চতুর্ভুজের আদলে কিছু একটা আছে ! কাজেই সেই দিকও হবে না ! তার মানে পশ্চিম ! আর পশ্চিম হলে ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারছিস ! মানে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের দিকে এগোতে হবে ! “

শৈবাল বলে উঠলো আনন্দে – “গুরু ! ফাটাফাটি ! পুরো জমে খির !”

অজয় থামিয়ে দিয়ে বললো – “আস্তে – আস্তে ! সবাই জেগে যাবে !”

“তাহলে পরের লাইন গুলো তো খাজনার কথাই বলেছে, তাই না ?” – প্রশ্ন করলো শৈবাল !

অজয় বললো – “হাঁ ! পশ্চিম দিকে এগিয়ে চললে কোনো একটা জায়গায় সেই ধনসম্ভার রাখা আছে ! তবে, আমার কাছে ইংরেস্টেসটিং হলো দুটো জিনিস ! এক, কতটা দূরে ? আর, দুই, ছড়িয়ে আছে যোজন জুড়ে মানেটা কি ? তার মানে কি সেই খাজনা এক জায়গায় রাখা নেই ? আর, রাখা থাকলেও সেই জায়গা পাহাড়পুর থেকে কত দূরে ? সেটা তো বলা নেই ! নাকি কিছু আমরা মিস করে যাচ্ছি ?”

শৈবাল বললো – “এই কথাটার মানে কি ? পদচারণার ভাবনায় ? এটা মানে কি হাঠতে বলেছে ?”

অজয় বললো – “ঐখানেই খটকাটা লাগছে ! যদি হেঁটেই পাওয়া যাবে তো আবিষ্কার হওয়ার বহু বছর পরেও কেও খুঁজে পেলো না ! না – আমার সেটা মনে হয় না ! কিন্তু, পদচারণা কেন বলেছে – সেটাই ভাবছি ! মনে হচ্ছে রাতে আজ একটু পাল-বংশ নিয়ে নেট ঘেটে পড়াশোনা করতে হবে ! তুই শুয়ে পর ! “

এই কথা শুনে – শৈবাল মুখে চাদর টেনে ঘুমিয়ে পড়লো !

আর, অজয় টেবিলের ওপর ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে ল্যাপটপে ইন্টারনেট ঘেটে পাল বংশ নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকলো !

অষ্টম পর্ব :
সকাল আটটায় শৈবালের ঘুম ভাঙলো ! দেখলো বিছানায় অজয় নেই !

“কি করছে কে জানে ! কাল কখন ঘুমোল ! কিছু বার করতে পেরেছে ?” – মনের মধ্যে এসব ঘুরপাক খাচ্ছে শৈবালের !

সকাল নটার মধ্যে ফ্রেশ হয়ে স্নান করে বেরিয়ে দেখে অজয় উষ্কখুস্ক চুলে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে, আর কি যেন মনে-মনে বিড়বিড় করছে !

শৈবাল বুঝতেই পারলো প্রায় সারারাত লড়াই করেছে ধাঁধার সঙ্গে ! ওকে জিজ্ঞাসা করতে অজয় সেটাই বললো – “এই তিন আর চার নম্বর লাইন দুটোই গড়বড়ে ! কিছু একটা মিস করে যাচ্ছি – বুঝলি !”

শৈবাল বললো – “শোন ! সারারাত লড়েছিস ! এবারে একটু রেস্ট দে ! নাহলে মাথা কাজ করবে না ! তুই স্নান করে ব্রেকফাস্ট করে একটু ঘুমিয়ে নে ! আমরা পিসিকে বলে যাচ্ছি যাতে আমরা না আসা পর্যন্ত তোকে না ডাকে ! তারপর, ফিরলে একসাথে লাঞ্চ করবো ! কি বলিস ? আর, তার থেকেও বড়ো হলো – আমরা এই অল্প সময়ের মধ্যে কিন্তু অনেকটাই এগিয়ে গেছি ! তাই, এইটুকু সময় গেলেও ঠিক আছে ! যা এবারে একটু রেস্ট নে !”

অজয়ের কথাটা ঠিক মনের মতো নাহলেও বোঝা যাচ্ছে শরীরের দিক থেকে আর পারছে না ! এই কদিনে যাতায়াত আর ধকল তো সইতে হয়েছে ! তার ওপর জেটল্যাগও তো আছে ! তাই না চাইলেও রাজি হয়ে গেলো !

শুধু বললো – “একটা সঞ্জয় আর মৌকে ছোট্ট আপডেট দিয়ে খেয়ে শুয়ে পরবো ! তোরা যা ঘুরে আয় ! তবে চোখ-কানটা একটু খোলা রাখিস !”

শৈবাল – “ঠিক আছে বলে দরজা বাইরে থেকে টেনে দিয়ে চলে গেলো !”

অজয় ইমেইলটা করে দিয়ে কোনোরকমে ব্রেকফাস্ট করে শুয়ে পরলো !

ঘুম ভাঙলো যখন শৈবাল এসে ধাক্কা দেওয়ার পর ! চোখ খুলে দেখে – শৈবাল ডাকছে “এই কুম্ভকর্ণ ! কি ঘুম তোর মাইরি ! কখন থেকে ডেকেই চলেছি – বলছি খেতে আয়, তা মালের কোনো সারা নেই ! ওঠ এবারে ! কটা বাজে জানিস ? দুপুর তিনটে ! সেই সকাল নটা থেকে তিনটে অব্দি ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোলি ! এবারে ওঠ ? পিসি তোর জন্য অপেক্ষা করছে ! তুই গেলে – পিসি তোকে খাবার বেড়ে দিয়ে ঘুমোতে যাবে ! যা !”

এইবারে, অজয় খুব লজ্জা পেয়ে ধড়মড় করে উঠে মুখটা ধুয়ে নিয়ে খেতে বসে গেলো ! আর পিসিকে বললো – “ইস ! কি কেলেঙ্কারি কান্ড পিসি ! আপনি আমার জন্য বসে আছেন ! “

পিসি হেসে বললো – “তাতে কি হইছে ? তোমরা গিয়ে হইলা আমার শিবুর বন্ধু ! তোমাগো লগে কত্ত টান সবার ! রোজি তো খাই ! একদিন না হয় তোমাগো লগে একটু কথা কইলাম ! “

শুনে অজয় আরো লজ্জা পেয়ে গেলো ! বললো – “এবাবা ! পিসি আপনি খান নি ? ছি-ছি কি কান্ড দেখুন তো !”

খেয়ে নিয়ে উঠে মুখ ধুয়ে শৈবালের হারুনের সাথে চাকরাইলের চারপাশ একটু ঘুরে দেখতে গেলো ! হারুনকে জিজ্ঞাসা করলো – ” তুমি যে আমাদের সঙ্গে অফিসের দিনে ঘুরছো ! কোনো অসুবিধা হবে না তো ?”

হারুন বললো – ” জি ! দেহেন দাদা ! রোজ রোজ তো আর যাই না ! আপনারা হলেন ওপার বাংলার মানুশ – আমাগো অতিথি ! আমাগো-তো একটা দায়িত্ব তো থাইকা যায় ! কি কন ?”

শুনে অজয় মনে-মনে এদের আতিথেয়তার প্রশংসা না করে পারলো না !

ঘন্টা দুয়েক সব ঘুরে তারপর ওরা বাড়ি ফিরলো সন্ধে সাতটা নাগাদ ! কাজের ফাঁকে এই ঘোরাটা বেশ একটা মেন্টাল রিফ্রেশ দিয়েছে !

পিসি গরম-গরম চা দিয়ে গেলে, খেয়ে অজয় বললো – “ভাই, আজ তোর পিসির হাথে পদ্মার সর্ষে-ইলিশ আর কচি-পাঠার মাংস খেয়ে পেট পুরো ভোরে গেছিলো ! এই হাঠাটার খুব দরকার ছিল ! তবে, এটা মানতেই হবে যে তোর পিসির হাথের রান্না যেন অমৃত ! সারা জীবন মনে থাকবে এই স্বাদ !”

শৈবাল হেসে বললো – “তাহলে ভালো জায়গায় তুলেছি বল তোকে ? “

অজয় হেসে বললো – “তা আর বলতে ! তবে, এবারে আমাদের আসল জিনিসে আবার নজর দিতে হবে ! চল ! শুরু করি আবার !”

এর মধ্যে পিসি আরো এক পাশের বাড়ির বয়স্ক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে হাজির ! বললেন – “ইনি আমার আপা ! পাশেই থাকেন ! কলকাতা থেকে কেও এলেই উনি দেহা করেন ! “

আপা বললেন – “কলকাতার রাজাবাজারে আমার ছোটবেলার পাঁচটা বছর কাটিয়েছি ! তাই শুনলে মনটা আর ধরে রাখতে পারিনা ! ছুইট্টা চলে আইসি !”

শুনে অজয় বললেন – “সেতো হবেই ! নিজের লোক, নিজের দেশ থেকে আসলে মনটা তো চাইবেই !”

শুনে আপা বললেন – “কি সুন্দর কথাহানি কইলে গো ! বড়ো ভাল লাগলো ! তোমরা কথা কও ! আমি যাই ! নাতিটারে খাওইতে হবে ! ভীষণ দুস্টু হইছে ! কারোর কথা মানে না !”

যাওয়ার আগে বললেন – “তা তোমরা আইলে কোথা দিয়া ? মানে এদেশে ঢুকলে কোন দিক হইয়া ?”

শৈবাল বললো – “ওই মালদা থেকে গৌড় হয়ে গেট পেরিয়ে এলাম !”

তখন আপা বললেন – “ওহ ! গৌড় থাইকা ? ছোটবেলায় আমার আব্বা মজা কইরা কইতেন – পদচারণা কইরা পদচারণা হইতে আইতে হয় !”

শুনেই অজয় আর শৈবাল চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলো – “পিসিআপা, তার মানে কি ? পদচারণা হইতে মানে ?”

তখন আপা হেঁসে বললেন – “আরে পদচারণা মানে হইলো পায়ে হাইট্টা ! আর, পদচারণা হইতে হইলো গিয়ে তোমাদের ওই কি ইংরেজিতে কি কয় না, জেহান হইতে তোমরা আমাগো দেশে আইস ! সেই, বড়ো চাদির মতো দোয়ারহানা !”

এবারে, অজয় বললো – “আপা, আপনি কি গৌড়ের স্ট্রাডেলের কথা বলছেন ! মানে যে গেটটা দিয়ে আমরা বাংলাদেশে ঢুকলাম ?”

আপা হেসে বললেন – “ওই হলো ! তোমরা কি ইস্টাডেল যারে কও, আমরা তারে কই পদচারণের দোয়ার ! একই হইলো গিয়া ! না এবারে আমি আইসি গো ! তোমরা সব ভালো থাইকো ! “

এই বলে আপা চলে গেলেন ! আর, সঙ্গে যেন শৈবাল আর অজয়ের জন্য খাজনা দিয়ে চলে গেলেন ! উত্তেজনায় আর আনন্দে দুজনে-দুজনকে জড়িয়ে ধরলো ঘর থেকে আপা, পিসি আর ওদের ভাই বেরিয়ে যাওয়ার পরেই !

সঙ্গে-সঙ্গে পকেট থেকে ফোন করে সঞ্জয়কে একটা কল ! ফোনটার হেডফোনের একটা অজয় আর অন্যটা শৈবাল কানে লাগলো ! কারণ, স্পিকারে দেওয়া যাবে না !

অজয় বললো – “আমাদের মনে হয় মিশন সাকসেসফুল ! “

উল্টোদিক থেকে সঞ্জয় প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো – “বলিস কিরে ? তোরা খুঁজে পেয়ে গেছিস ? কোথায় আছে ভারাকবর্ষে না বাংলাদেশে ?”

অজয় বললো – “শোন ! ধাঁধার যা মানে দাঁড়াচ্ছে – সেই মতো গেলে গৌড়ের স্ট্রাডেলের কাছে বেশ খানিকটা অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে ! তাতে, কিছুটা ভাগ বাংলাদেশে পড়লেও অবাক হবো না ! তবে কোন দিকে বেশি আছে, সেটা এক্ষুনি বলতে পারবো না ! তার জন্য আরও কিছু কাজ আছে !”

শুনে সঞ্জয় বললো – “জিও ! পাগলা ! তোর জন্য লুচি, আলুর দম আর পায়েস ! তুই চলে আয় ! বাকি কাজটা সেরে ফেলা যাক !”

দুজনেই হেসে বললো – “হাঁ ! আমরা কাল এখানে আরেকটা ছোট লাইব্রেরিতে যাবো ! কিছু ডকুমেন্টস এখান থেকে পাওয়া যাবে ! যাতে বোঝা যাবে, এখানে ও এর চারপাশে ব্রিটিশরা চলে যাবার পর থেকে কোথায়-কোথায় খনন হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিকদের জন্য ! এটা খুব দরকারি ! তাহলে, আমরা আরো নিশ্চিত হয়ে যাবো ! তুই, পরশুদিনের বাসের টিকেট কেটে ইমেইল করে দে বর্ডার পর্যন্ত ! তারপর, আমরা একই ভাবে হেঠে গৌড়ে ঢুকে যাবো !”

সঞ্জয় বললো – “হাঁ ! সেটাই ভালো ! তাহলে, তুই ঐখান থেকেই শুরু করতে পারবি ! আমি এক্ষুনি সব ব্যবস্থা করছি !”

নবম পর্ব :
পরের দিন সকালে উঠেই অজয়, শৈবাল ও হারুন ছুটলো কাছের বড়ো লাইব্রেরিতে ! হারুনের কার্ড আছে ! তাই, ওখানে ওই কার্ড দেখিয়ে পুরোনো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক বই, কিছু পুরোনো আবিষ্কারের খবরের কাগজের কাটিং পাওয়া যাবে !

যা ওদের ভীষণ দরকারি ! সেই মতো ওরা লাইব্রেরিতে গিয়ে সব কিছু জোগাড় করে পড়তে থাকলো ! অজয় আর শৈবাল খাতা কলম কিনে তাতে যেকোনো কিছু সন্দেহের মনে হলে নোট করতে থাকলো ! আর, হারুন যাবতীয় পুরোনো খবরের কাগজ যাতে সোমপুর মহাবীরের কথা বলা আছে, সেগুলো ফটোকপি করে নিয়ে এলো ! সব মিলিয়ে ঘন্টা চারেকের মধ্যে বেশ ভালো একটা তথ্যের খাজনা করে আয়োজন করে ফেললো !

বিকেল বেলায় বাড়ি ফিরে সব খবর সঞ্জয় আর মৌকে দিয়ে, ওইসব পুরোনো পেপার গুলো পড়তে থাকলো ! আর বিশেষ-বিশেষ খবরে লাল মার্কিং করে রাখলো !

রাতে খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো দুজনেই ! বাংলাদেশে কাজ এখন শেষ ! এবারে, দেশে ফেরার পালা ! চাপা উত্তেজনায় যেন ঘুম আর আসছে না !

অজয় এও ভাবছে – “এতো পুরোনো পেপার কাটিং নিয়ে যাচ্ছে, সিকিউরিটি চেকের সময় কেও কিছু বলবে না তো ? দেশে তো অসুবিধা নেই ! এদিকেই, যা গন্ডগোল তা হতে পারে ! “

সেই ভেবে হঠাৎ সব পেপার কাটিং মোবাইলেই স্ক্যান করে সঞ্জয়ের ইমেইলে পাঠিয়ে দিলো প্রায় সারারাত জেগে থেকে ! এর মধ্যে ভোর পাঁচটা বেজে গেছে !

অজয় আর না শুতে গিয়ে স্নানে চলে গেলো ! স্নান করে ফিরে এসে শৈবালকেও ডেকে দিলো !

শৈবাল জিজ্ঞাসা করলো – “ওহ বাবা ! তুই উঠে পড়েছিস ? এতো আগে ?”

অজয় শুধু – “হুন” – বলে কাটিয়ে দিলো !

এরপর, শৈবাল স্নান করে বেরিয়ে পিসির হাথের জল-খাবার খেয়ে তারপর তিনজনে মিলে বর্ডারের দিকে রওয়ানা হলো ! গাড়ি আগে থেকেই বুক ছিল ! তাই, পৌঁছাতে বিশেষ অসুবিধা হলো না !

বর্ডার এ পৌঁছে হারুনকে বিদায় জানিয়ে মালপত্র নিয়ে সিকিউরিটি চেক করতে ঢুকে গেলো ! সারা রাত না ঘুমোনোর পরেও অজয় যেন এখনো চাঙ্গা ! মনের মধ্যে এড্রিনালিন এর ফুটন্ত রক্ত বয়ে চলেছে !

এরপরে, অজয়ের ডাক পড়লো ! সব সিকিউরিটি চেকের পর – অজয়কে একটু দাঁড়াতে বললো !

এইবার যেন অজয় একটু চাপ অনুভব করলো ! “কি হলোরে বাবা, এরা কিছু বুঝে গেলো নাকি ? “

প্রায় পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে আছে ! শৈবালের হয়ে গেছে – ও বেরিয়েও গেছে ! অজয় মনে-মনে ভাবলো – “আশা করি ও বাংলাদেশের জমি থেকে দেশে ঢুকে গেছে !”

এইবার, একটু মৃদু গলায় জিজ্ঞাসা করলো – “স্যার, কিছু প্রব্লেম আছে ? মানে দাঁড়িয়ে আছি এতক্ষন ধরে ?”

অফিসার বললেন – “না দাদা ! আমাদের যন্ত্রটা একটু বিকল হয়ে গেছে ! তাই, আরেকটা নিয়ে আনতে গেছে ! একটু, অপেক্ষা করতে হবে !”

এবারে, অজয় বললো – “আসলে আমার বন্ধুর অপারেশন আছে আজ ! ওর “ও-নেগেটিভ” ব্লাড গ্রুপ, যেটা আমার আছে ! তাই, আমি তড়িঘড়ি করে ফিরে যাচ্ছি যদি ওর লাগে তো আমি দিতে পারবো !”

অফিসার বললেন – “‘ও-নেগেটিভ’ তো দুষ্প্রাপ্য ! তা আপনার বন্ধু থাকে কোথায় ?”

অজয় জবাব দিলো – “আজ্ঞে, মালদা !”

আবার অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন – “পাসপোর্টে তো আপনার বাড়ি কলকাতায় ! তাহলে উনি আপনার কি করে বন্ধু হলেন ?”

অজয় বললো – “না ! আমরা দুজনে এক সাথে আমেরিকাতে পড়াশোনা করেছি ! দেশে ও ঘুরতে এসেছিলো ! এসে অসুস্থ হয়ে পরে ! জানা যায় ওকে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে ! সেই অপারেশন করতে হলে অনেক রক্ত লাগবে ! আজই তার ডেট ! দুপুর দুটোয় ! তাই, এতো তাড়াতাড়ি চলে এসেছি ! যদি আপনি একটু ব্যবস্থা করে দিয়ে আমায় একটু ছেড়ে দেন তো খুব ভালো হয় ! বুঝতেই তো পারছেন – গৌড় থেকে মালদা যেতে আবার লাগবে প্রায় এক ঘন্টা !”

এই কথা শোনার পর অফিসার মাথা নেড়ে বললেন – “মোফাজ্জল, ওনারে একটু প্রায়োরিটি করে ছেড়ে দাও ! পেশেন্ট কেস আছে !”

অন্যদিকে, অফিসার ডেকে নিলো অজয়কে ! অজয় পাসপোর্টটা দিয়ে দিতে উনি স্ট্যাম্প মেরে ব্যাগটা আরেকবার চেক করে বললেন – “যান ! হইয়া গেছে গিয়া !”

অজয় – “ধন্যবাদ” জানিয়ে ব্যাগ আর কাগজ নিয়ে বাইরে বেরোতে সামনে বিডিআর-এর জওয়ানকে ওই কাগজটা দেখাতে হলো ! উনি একবার কাগজটা দেখে নিয়ে অজয়ের পাসপোর্টটা চাইলেন !

অজয় পাসপোর্টটা দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো আর মনে-মনে ভাবতে লাগলো – “এইখানে এসে আটকে যাওয়ার কোনো মানেই হয়না !”

ওই জওয়ান ভালো করে পাসপোর্ট দেখে আর ছবির সাথে অজয়ের মুখ দেখে মিলিয়ে নিয়ে বললেন – “এই সাইড ধরে হেঠে চলে যান ! ওই গেট পেরোলেই ভারত ! ওখানে, আবার সব কাগজপত্র দেখাতে হবে !”

অজয় আবার “ধন্যবাদ !” বলে হনহন করে হাঁঠা লাগলো ! মাত্র একশো মিটার পেরোতে যেন মনে হচ্ছিলো কয়েক যুগের হাঠা ! অবশেষে, দূর থেকে শৈবাল, সঞ্জয় আর মৌকে দেখতে পেলো !

বিএসএফ-কে আগেই বলা ছিল ! তাই, ওরা বেশি প্রশ্ন না করে অজয়কে নিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে নিয়ে চলে গেলো ! ইমিগ্রেশন অফিসার শুধু পাসপোর্ট দেখে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বললেন – “ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়া !”

এতক্ষনে, অজয়ের মুখে একটু স্বস্তির হাসি এলো ! ও হাফ ছেড়ে – “থ্যাংক ইউ দাদা !” বলে বেরিয়ে এলো !

দশম পর্ব :
বেরিয়ে এসে তিন বন্ধু জড়িয়ে ধরলো ! 

সঞ্জয় বললো – “কাঁপিয়ে দিয়েছিস ! উফফ ! ভাবা যায় ! এবারে, বল কি করতে হবে ! তার আগে চল – আগে কিছু একটু সবাই খেয়ে নি ! সকাল থেকে চিন্তার জন্য আমি আর মৌ কিছুই খেতে পারিনি ! ভাবছি, যদি ওখানে লোকাল লোকেরা কোনো ঝামেলা করে ! এইসব !”

অজয় বললো – “নারে সেসব কিছুই হয়নি ! বরং, কলকাতা থেকে ঘুরতে গেছি শুনে সবাই খুব খাতিরও করেছে ! কোনো অসুবিধা হয়নি ! শুধু, এইখানে এসে ওদের ইম্মিগ্রাশনের ওখানে একটু চাপ লাগছিলো, যখন বললো অপেক্ষা করতে ! আমি ভাবলাম কিছু গড়বড় হলো নাকি ? সেরকম তো কিছুই করিনি ! তবে, যাইহোক শেষে একটু ছোট্ট ঢপ মেরে আমার চেকটা তাড়াতাড়ি করিয়ে নিলাম ! এছাড়া, আর কোনো অসুবিধা হয়নি !”

সঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলো – “ঢপ মানে ? ঠিক বুঝলাম না !”

অজয় বললো – “ও সেসব পরে বলবো ! আপাতত, খিদের জ্বালায় পেট জলে যাচ্ছে ! দাঁড়াতে পারছি না ! শিগগির আগে একটু কোথাও গিয়ে বসে খাই ! নাহলে আর কিছু পারবো না !”

সেকথা শুনে – মৌ বললো – “হাঁ ! এইবার সবাই চলো ! আগে একটু খেয়ে বিশ্রাম নেওয়া যাক ! তারপর, কি করতে হবে – সে নিয়ে গভীরভাবে ভাবা যাবে !”

সবাই এক-কথায় রাজি হয়ে গেলো ! এইবার, প্রথম অজয় নিজে গিয়ে মৌয়ের পাশে বসলো ! মৌ দেখে একটু মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলো – “শরীর ঠিক আছে তো ? জেটল্যাগ আর নেই তো ?”

অজয় বললো – “না ! এখন অনেকটাই বেটার !”

মৌ বললো – “ঠিক আছে ! খুব ভালো ! বাড়িতে একটা ফোন করে দাও আগে ! নাহলে বাড়িতে সবাই চিন্তা করছে ! তোমার, আমার দুই বাড়ি থেকে !”

এই কথা শুনে অজয়ের বুঝতে বাকি রইলো না কথাগুলোর তাৎপর্য কি ! আবার যেন খানিকটা অবাক হয়ে ঘোরের মধ্যে শুনে গেলো ! কথাগুলো অবশ্য শুনতে ওর খুব ভালোই লাগছিলো ! কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা, আনন্দ ও আরো কত কি !

খেয়ে নিয়ে একটু সস্তির নিঃস্বাস ফেললো ! তারপর, অজয় বললো – “শোন ! আমি এটুকু নিশ্চিত যে – দামি জিনিসের কথা বলা হয়েছে, তা স্ট্রাডেলের চারপাশেই আছে ! খুব দূরে হয়তো হবে না ! কিন্তু, ধাঁধা থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে এক জায়গায় সব রাখা নেই ! বেশ কয়েকটা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ! এটা হয়তো করা হয়েছে এই জন্য, ইংরেজরা কিছুর সন্ধান পেলেও সব গুলো একসাথে যাতে না পায় ! তবে অসুবিধা হচ্ছে এর থেকে বেশি আর কিছু বলা নেই ! “

শুনে সঞ্জয় বললো – “এই মেরেছে ! যদি সবটা ওপারে থেকে যায়তো ? সেক্ষেত্রে আমাদের খাটাই সার হবে ! ওরা নিয়ে সব চলে যাবে !”

এই কথা শুনে অজয় বললো – “না সেটা হবে না ! ছড়িয়ে কিছু জায়গায় এমনভাবে রাখা হয়েছে ! তাতে একবারে অনেকটা পাওয়া গেলেও, যা ভান্ডার ছিল, তার হয়তো কয়েকভাগ হবে !”

সঞ্জয় বললো – “যেন তোর কথাই ঠিক হয় ! তাহলে, এখন কি উপায় ? আর তো কোনো কিছু তো বলা নেই ! মুশকিল হচ্ছে, এই জায়গার চারপাশে বিএসএফ আর উল্টোপারে বিডিআর আছে ! আমাদের লোককে হাত করলেও ওদের লোককে হাত করা যাবে না ! তাহলে ?”

অজয় বললো – “শুনলাম কিছুদিন আগে ভারত মহাকাশে একটা স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে যেটা জমির অনেক তথ্য দেয় ! তাদের, কোনো একটাকে সরকারকে বলে পুরো এইজায়গায় একটা স্ক্যান করে নে না ! জমির গঠনের ওই এক্সরে দেখলেই আমরা বুঝতে পারবো !”

শুনে সঞ্জয় বললো – “ভাই তুই সামরিক স্যাটেলাইটে ব্যাবহার করার কথা বলছিস ! আর সেই সার্ভিস নিতে গেলে আধ ঘন্টাতেই যা খরচ পরবে, আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক বছরের বাজেট ! আর, তার ওপর পুরো মালদা ও গৌড় নিতে গেলে অনেক সময় ও খরচ হবে ! সেটা সম্ভব নয় ! তুই যদি কোনো ভাবে দুই থেকে তিনটে খুব ছোট জায়গার পরিসর বলে দিতে পারিস, সেই ক্ষেত্রে তাও আমি একটা চেষ্টা করতে পারি ! গোটা জায়গা হবে না !”

তখনই অজয়ের মাথায় একটা ঝিলিক খেলে গেলো !

অজয় বললো – “মেশিন লার্নিং এর ফোরকাস্ট মডেল ব্যবহার করে হয়তো আমরা জায়গা বার করতে পারি ! তবে তার জন্য আমার বেশ কিছু ডাটা লাগবে !”

সঞ্জয় আর মৌ জিজ্ঞাসা করলো প্রায় এক-সঙ্গে – “মেশিন লার্নিংটা কি ?”

এইবার, অজয় বললো – “তাহলে তোদেরকে আমার থেকে একটা ক্র্যাশ-কোর্স করতে হবে !”

সঞ্জয় আর মৌও রাজি হয়ে গেলো !

অজয় বলতে শুরু করলো – “ছোটবেলার কথা ভাব, বাচ্চা বয়সে শিশু যখন কিছুই চেনে না ! তারপর, তার “মা” বা “বাবা” বা যার কাছে সে মানুষ হয়, তারা প্রথম কয়েকবছর তাকে নানা জিনিস দেখিয়ে তার নাম বলে তাকে বা ওই বস্তুকে চেনাতে সাহায্য করে ! যেমন ধরে “আপেল” ও গোল আবার “কমলা লেবুও” সেরকমই গোল ! তাহলে, শিশু সেই ক্ষেত্রে রং দেখে তফাৎটা করতে শেখে – কারণ সেই ক্ষেত্রে তার বাড়ির লোক বলে – ‘এটা কমলা রঙের, তাই কমলা লেবু ! এটা লাল রঙের – তাই আপেল ! মেশিন লার্নিং এর ভাষায় একে বলে ‘ট্রেইন ডাটা’ বা ‘শিক্ষাপ্রদানকারী তথ্য’ ! বুঝলি ?”

ওরা দুজনেই একসাথে মাথা নেড়ে বললো – “হাঁ” !

“বেশ ! এবারে, শিশু যখন বেশ কিছুদিন বা বছর ধরে ওইভাবে চিনতে থাকে তখন সে নিজে থেকেই হোক বা অন্য কোনো তথ্যের ভিত্তিতে একটু-একটু করে চিনতে শেখে ! তখন, যদি তাকে একটা সবুজ আপেল আর হলুদ বা পাকা পেয়ারা দেখাস – অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে তারা নিজেরাই বলতে পারে – সবুজ হলেও সেটা আপেল আর হলুদ হলেও সেটা পেয়ারা ! অর্থাৎ, তার আগের মডেলের ওপর ভিত্তি করে – সে এই নতুন দুটো জিনিসকে চিনতে পেরেছে ! এই ক্ষেত্রে সবুজ আপেল আর হলুদ পেয়ারা হলো মেশিন লার্নিং এর ভাষায় ‘টেস্ট ডাটা’ বা ‘বাস্তব তথ্য’ ! বুঝেছিস ?”

এবারেও ওরা দুজনে মাথা নেড়ে বললো – “হাঁ ! বুঝলাম !”

অজয় আরো বলতে থাকলো – “এইবার, যদি কোনো শিশু ওই সবুজ আপেলকে দেখে পেয়ারা বলে সেই ঘটনাকে মেশিন লেয়ার্নিংয়ের ভাষায় বলে – ‘ফলস পসিটিভ’ অর্থাৎ ‘ভুল ধনাত্মক’ ! বুঝলি ?”

এইবারে, মৌ বললো – “এইখানটা ঠিক পরিষ্কার হলো না !”

অজয় বললো – “বেশ ! তাহলে আরেকটা উদাহরণ দি ! ধরে নে তোর ব্লাড-টেস্ট হয়েছে ! ভুল করে তোর রিপোর্ট এলো যে তোর ম্যালেরিয়া হয়েছে ! সেটা হলো — ‘ফলস পসিটিভ’ ! আর, তোর সত্যি ম্যালেরিয়া হয়েছে – কিন্তু তোর রিপোর্টে তা এলো না ! সেটা হলো — ‘ফলস নেগেটিভ’ ! আর তোর ম্যালেরিয়া হয়নি, রিপোর্টেও তাই এসেছে — সেটা হলো – ‘ট্রু-নেগেটিভ’ ! আর, তোর ম্যালেরিয়া হয়েছে – রিপোর্টেও সেটা এসেছে – সেটাকে বলবে — ‘ট্রু-পসিটিভ’ ! “

“এই সম্ভাব্য চারটে বিকল্প ধারণাকে মেশিন লেয়ার্নিংয়ের ভাষায় বলে – ‘কনফিউশন ম্যাট্রিক্স’ বা মজার করে বলতে গেলে – ‘ধাঁধালো উত্তর’ ! এইবার, এই চার্টটা দেখ ” – বলে একটা ছক কেটে দেখিয়ে দিলো অজয় !

“এবারে লক্ষ্য করে দেখ বাঁ-দিকের ওপরের উত্তরের সঙ্গে কোনাকুনি নিচের উত্তর সঠিক যা সবুজ অক্ষরে লেখা আছে ! আবার, ডানদিকের ওপরের উত্তরের সঙ্গে বাঁ-দিকের নিচের উত্তর ভুল যা লাল-অক্ষরে লেখা আছে ! অর্থাৎ, যেকোনো কিছু ভবিষ্যৎবানী করতে গেলে সব সময় শতকরা পঞ্চাশ শতাংশ সঠিক হওয়ার সম্ভবনা থাকে ! এবারে, নিশ্চই বুঝতে পেরেছিস ?” – বললো অজয় !

এবারে, দুজনেই বললো – “জলের মতো ! কিন্তু, তার সঙ্গে আমাদের এখনকার ঘটনার যোগটা কি ? সেটা বুঝতে পারছি না !”

এবারে, অজয় বললো – “না ! আছে ! তোদের তাহলে আমার এখানে আসার আগে স্ট্যানফোর্ডের গবেষণার বিষয়বস্তুটা আর সেটার সার্থক হওয়ার ঘটনাটা একটু বলি ! বেশি বলতে পারবো না ! কারণ, উনিভার্সিটির বারণ আছে ! এই মেশিন লেয়ার্নিংয়ের মাধ্যমে যেকোনো প্রোগ্রামিং করা মডেল অনেক কিছুই নির্ভুলভাবে প্রেডিক্ট করে দিতে পারে ! যেমন ধরে নে – বিগত কুড়ি বছরের আবহাওয়া, ছোটোখাটো বা বড়ো দাবানল, গাছের বা জঙ্গলের ঘনত্ব – এইসব ভ্যারিয়েবলের বা যেসব চরিত্র পাল্টে যায়, তাদের সাহায্যে ভবিষ্যতে কবে আর কোথায় দাবানল লাগতে পারে, তার নির্ভুল অংকের মাধ্যমে গণনা করে বলে দেওয়া যায় ! এই গণনা প্রায় আশি থেকে নব্বই শতাংশ মিলে যায় ! ঠিক সেই একইভাবে কিছু ডাটার ওপর ভিত্তি করে আমি হয়তো দুই থেকে তিনটে জায়গা, যেখানে হওয়ার সব থেকে বেশি চান্স – সেটা বলে দিতে পারি ! এর জন্য আমায় জ্যোতিষী হতে হবে না ! অংক দিয়েই কিস্তিমাত করবো ! আর, তার জন্য আমি কাউকে পলা বা বিশেষ ধাতু ধারণ করতেও বলবো না ! “

এইবার, ওরা দুজনেই পুরো হাঁ হয়ে গেছে ! সঞ্জয় বললো – “তুই এর ওপর কাজ করেছিস ?”

উত্তর এলো – “হাঁ”

আবার সঞ্জয় বললো – “তোর সাকসেস রেসিও কত ছিল ?”

উত্তর এলো – “শতকরা বিরানব্বই শতাংশ !”

সঞ্জয় এবারে বসে পড়লো ধুপ করে চেয়ারে ! বুঝতে পারলো যে এমনি-এমনি ওকে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টরেট ডিগ্রিটা দেয় নি !

তখন, মৌ জিজ্ঞাসা করলো – “তোর এর জন্য কি ডাটা লাগবে ?”

অজয় বললো – “আমায় একটু ডিটেইলে স্টাডি করতে দে বাংলাদেশের ডকুমেন্টগুলো যেগুলো কপি করে নিয়ে এসেছি ! তারপর বলছি ! তবে, আমার আবহাওয়ার ডাটা লাস্ট একশো বছরের হলে ভালো হয় ! ওটা ভীষণ দরকারি ! তার সাথে এই অঞ্চলে কবে কোথায় কি জিনিস মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে তার একটা ডিটেইলে হদিশ চাই ! মানে তারিখসহ কি পাওয়া গেছে ! এই অঞ্চলে কোনো বন্যা হয়েছিল কিনা ? এখানে, কোনো আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিলো কিনা ? শেষ কবে মাটি খোঁড়া হয়েছে যেকোনো কাজের ? আর, তার সঙ্গে যদি মিউনিসিপ্যালিটির ওই খোঁড়ার তারিখ, কোথায় খোঁড়া হয়েছে, আর কত ফিট খোঁড়া হয়েছে ? এই কটা তথ্য আমার চাই ! আর, এটা শুধু ভারতের হলে চলবে না, বাংলাদেশেরও এই সংলগ্ন এলাকার চাই !”

সঞ্জয় বললো – “আবহাওয়াটা নাহয় হয়ে যাবে ! কিন্তু, বাংলালাদেশের দিকের তথ্যগুলোই তো মুশকিলের ! দুই সরকারের মধ্যে সবে কথাবার্তা শুরু হয়েছে ! কিছু সময় তো লাগবেই !”

অজয় বললো – “যা লাগবে, আমি তা বলে দিলাম ! বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমি নিয়ে এসেছি ! কিন্তু, যত বেশি আমার কাছে ঐতিহাসিক তথ্য থাকবে, তত ভালো আমার মডেল প্রেডিক্ট করতে পারবে !”

“আপাতত, তুই আমাদেরকে একটা গেস্ট হাউসে নামিয়ে দিয়ে ডাটা জোগাড় করতে বেরিয়ে পর ! আমরাও ভালো করে তথ্যগুলো আমার মডেলের উপযোগী করে দিতে থাকি ! এটা করতেও সময় লাগবে ! এতো সহজও নয় ! অনেক খাটা-খাটনির ব্যাপার আছে ! অনেক পড়াশোনা করতে হবে ! চল ওঠ এবারে !”

এই বলে সবাই উঠে গাড়িতে করে গৌড়ের কাছে একটা সরকারি বাংলোর দিকে চলে গেলো !

একাদশ পর্ব :
বাংলাদেশ থেকে বেশ অনেক ডাটাই একটা ছোট অথচ মোটা বই থেকে সব পেলো ! ওই বইয়ের লেখক জনৈক শিক্ষক ! যিনি ঘুরে-ঘুরে বাংলাদেশে প্রাচীন দর্শনীয় স্থানের আশে-পাশে কোথায় কি আবিষ্কার হয়েছে মাটি খুঁড়তে গিয়ে, তার একটা তথ্য সেখানে তারিখ সহযোগে দিয়েছেন ! এবং, সেই জিনিসপত্র কোথায় রাখা আছে, তারও বিবরণ দেওয়া আছে ! অজয়ের প্রথমের দিকের তথ্যটাই দরকার !

তাই, এক-এক করে সেগুলোর ডাটা এন্ট্রি করতে শুরু করতে থাকলো ! সঙ্গে, শৈবালও ওকে সাহায্য করতে থাকলো আরেকটা ল্যাপটপে অন্য তথ্যগুলো নিয়ে একটা এক্সেল ডকুমেন্টে ভরতে লাগলো !

সন্ধ্যেবেলায় সঞ্জয় ফিরলো ! এসে বললো – “তোর আবহাওয়ার ডাটা পাওয়া যাবে ! তবে কতটা ডিটেলস পাবি, সেটা কথা ! স্থানীয় চার-পাঁচটা পেপার খোঁজ করে যত এই অঞ্চলে খাজনার আবিষ্কারের খবর বেরিয়েছে ও বাংলাদেশের বর্ডারের কাছে, তার ও খবরের পাতাগুলো কাল সকালের মধ্যে পেয়ে যাবি ! কোনো আগুন লাগার খবরও জোগাড় করার চেষ্টা করছি দমকলের সাথে যোগাযোগ করে ওদের পুরোনো লগবুক দেখে ! মিউনিসিপ্যালিটিরও সব পুরোনো খোঁড়াখুঁড়ি ও টেলিফোনের জন্যও খোঁড়াখুঁড়ির সব খবর তুই আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে পেয়ে যাবি ! কিন্তু, আমার একটা প্রশ্ন আছে ? এই যে যেসব জোতিষিরা বলে কম্পিউটারে গণনা করে ভবিষ্যত বলে দেয়, এটাও কি তুই যেভাবে করিস, ওই একইভাবে ?”

অজয় হেসে বললো – “ভাগ্যিস এটা তুই আমায় বলেছিস ! অন্যকোনো লোককে বললে দেশে এইসব জ্যোতিষীরা আরও সুযোগ পেয়ে যেত তাদের বুজরুকি প্রচার করার ! শোন, ওদের যা সফটওয়্যার হয়, তাতে অংকের কোনো গল্পই নেই ! আর, যদিও কোনো-কোনো সফটওয়্যার-এ থেকেও থাকে, সেই অংক দিয়ে এইভাবে প্রেডিকশন করা সম্ভব নয় ! আর, তাছাড়া আমি কখনো বলবোনা তুমি এইটা পড়ো, তাহলে তোমার বিপদ কেটে যাবে ! ওটা তারাই বলবে যারা লোকের অভাব, দুঃখ, দুর্দশা আর অন্ধ-বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে নিজেরা দু-পয়সা অর্জন করে ! তাই, এই দুটোর মধ্যে গুলিয়ে ফেলিস না ! “
আরও বললো – “তাহলে তোকে একটা ছোট্ট জিনিস দেখাই, কি করে অংকের সাহায্যে ভবিষৎবাণী করে ! আর, সেটা কতটা সাইন্টিফিক !”
“ধরে নে, কোনো একটা হাসপাতাল মানুষের কাজ করার ধরণের থেকে তার বুড়ো বয়সে কোমরে ব্যাথা হবে – না তার স্পন্ডিলাইটিস হবে, তার একটা মডেল বানাতে চাইছে ! এই ক্ষেত্রে, নিচে বাঁ-দিক থেকে ডান-দিকে দেখানো হয়েছে কে – কত ঘন্টা একটানা বসে কাজ করে ! তার, ভিত্তিতে আমরা নিচ থেকে ওপরের দিকে কোমরের ব্যাথা মাপার চেষ্টা করছি ! মাঝখানে, যেখানে সবুজ কাটা দাগ আছে, সেখানটা বোঝায় সেই মানুষের সবে কোমরে ব্যাথা শুরু হয়েছে ! ” – বললো অজয় !
“এইবার, লজিস্টিক রিগ্রেশন মডেল যেটা আমরা তৈরী করেছি সেখানে আমরা ছোটবয়সের বাচ্চাদের মতো আগে তাকে চেনাব ! আমরা এই মডেলকে জানালাম যদি তুমি কম সময়ে একভাবে বসে কাজ করো, তাহলে তোমার কোমরে ব্যাথা হবে না ! এই ঘটনাটা আমরা নীল রঙের গোল দিয়ে বোঝালাম ! আর, যদি একটানা লম্বা সময় ধরে কাজ করো, তাহলে কোমরে ব্যাথা করতে পারে, এমনকি স্পন্ডিলাইটিসও হতে পারে ! যাকে আমরা লাল গোল দিয়ে বোঝাচ্ছি ! যদি, কম সময় কাজ করেও কোমরে ব্যাথা বা স্পন্ডিলাইটিস হয়, সেই ক্ষেত্রে ওই ঘটনাকে ব্যাতিক্রম ধরতে হবে ! যা এখানে গোলাপি রং দিয়ে বোঝানো হয়েছে ! যদিও, এই গোলাপি রঙের-গোল লালের দলেই পরে ! বুঝলি ? ” – বললো অজয় !
“এইভাবে, আমরা প্রথমে আমাদের মডেলকে ট্রেনিং দেব ! লাল গোল মানে অনেকখন কাজ করছে একটানা, আর নীল গোল মানে অল্প সময় কাজ করছে ! তাই, লাল-গোলে স্পন্ডিলাইটিস হচ্ছে, আর নীল-গোলে কোনো ব্যাথা নেই ! ” বললো অজয় !
“এইভাবে, আমরা আরো অনেক ডাটা দিয়ে আমাদের মডেলকে ভালো করে বোঝাবো, ঠিক যেমন বাচ্ছার অভিভাবকরা জীবনের প্রথম দিনগুলোতে তাদের শিশুদের ভালো করে সব কিছু বারবার করে চেনায় ! অনেক সময় একটানা বেশি কাজ করেও তাদের জীবনে খেলাধুলো বা যোগব্যায়াম বা সাঁতার খেলার জন্য তাদের কোনো কোমরে ব্যাথা নাও হতে পারে ! সেইরকম একটা ঘটনাকে হলুদ রং দিয়ে দেখানো হয়েছে ! যদিও এরা নীল রঙের দলেই পরে !” – বললো অজয় !
“শেষ পর্যন্ত ছোট শিশুদের শেখানোর পর ঠিক যেমন দুনিয়াতে ছেড়ে দেওয়া হয়, যাতে সে একা-একা সব কিছু চিনে নিয়ে কাজ করতে পারে, ঠিক সেইভাবে আমাদের মডেলকে এবারে নতুন কোনো মানুষের একটানা চোদ্দ-ঘন্টার বেশি বসে কাজ করার তথ্য দিলে, মডেল নিজে থেকে বলে দিতে পারবে যে এই মানুষটির স্পন্ডিলাইটিস হওয়ার সম্ভবনা খুবই প্রবল ! যেটা ওই লাল রঙের কাটা-কাটা দাগ দিয়ে বোঝানো হয়েছে ! এবারে বুঝলি – এই পুরো ব্যাপারটা কতটা জটিল আর কতটা বেশি সঠিক ?” – বললো অজয় !

অজয় বললো – “ঠিক এই ভাবে এই তথ্যের সাথে তারা কত বছর এভাবে কাজ করেছেন, সেই তথ্যকে জুড়ে দিয়ে আসল ভবিষ্যৎবাণী করা যাবে ! অর্থাৎ, আমাদের এক্ষেত্রে দুটোর বেশি তথ্য ভবিষ্যতবাণী করতে সাহায্য করলো !”

এইবার কিন্তু সঞ্জয় আর মৌ পুরো পদ্ধতিটার গুরুত্ব সঠিকভাবে বুঝতে পারলো ! এবং, কতটা জটিল অংক গণনার মধ্যে দিয়ে এই ভবিষ্যৎবাণীটা করা হয়ে থাকে !

সঞ্জয় এবারে বললো – “এইভাবেই তুই কোনো মাটি খোঁড়া, আবহওয়া, আগে পাওয়া খাজনা, আগুন লেগে কোনো জায়গা পুড়ে যাওয়ার পরেও কিছু খুঁজে না পাওয়া – এইসব তথ্যের ভিত্তিতে তোর মডেল আগে তৈরী করবি ! তারপর, তোর আসল ডাটা দিয়ে তুই যে জায়গা গুলোতে সব থেকে বেশি থাকার সম্ভবনা আছে, সেইরকম তিনটে জায়গা আমাদের জানাবি ! যা ভারতবর্ষ বা বাংলাদেশ যেকোনো দেশেই হতে পারে ! তাই তো ?”

অজয় বললো – “একদম ঠিক !”

সঞ্জয় বললো – “বুঝলাম ! তারপর, সেটা হয়ে গেলে আমি ইসরোর ডিরেক্টরের সাথে কথা বলে পৃথিবীর ওপর চক্করকাটা উপগ্রহের সাহায্যে জমির চারিত্রিক বিশ্লেষণ করে আমাদের সম্ভাব্য জায়গা বার করবো ! “

অজয় বললো – “একদম ঠিক ! কিন্তু, তোকে তার আগে তো ইসরোর সাথে কথা তো বলতে হবে ! এমনি-এমনি ওরা তোকে “ইওস-০১” ব্যবহার করতে থোড়াই দেবে ? ওই উপগ্রহটা শুনেছি ভীষণ ভালো ! “

সঞ্জয় বললো – “গুরু ! আমি শুধু প্রধানমন্ত্রীর অফিসে একটা ইমেইল করলাম, যে একটা বড়ো দেশের সম্ভাব্য প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হতে চলেছে ! এই গবেষণার সঙ্গে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য ডক্টরেট পাওয়া অজয় করও যুক্ত আছে ! তার তৈরী মডেলের সাহায্যে আমরা এই স্থান বার করতে চলেছি ! বাস ! তারপর, বাকি সব কিছুই আপনা থেকে হয়ে গেলো !”

শুনে অজয় বললো – “বলিস কি ? এবারে, তো আমার চাপ লাগছে শুনেই !”

সঞ্জয় বললো – “চাপ নিও না বন্ধু ! তুমি শুধু চালিয়ে যাও !”

অজয় বললো – “ঠিক আছে ! এখনো কাজ বাকি আছে ! দেখাই যাক – কি হয় !”

মৌ বললো – “ঠিক আছে ! আমরা বেরোচ্ছি ! আমাদেরকে জানাতে হবে কতটা এগিয়েছি, আরো কতদিন লাগবে এইসব ! আমরা করে আসছি ! ততক্ষন, তুই আর শৈবাল কাজ কর ! এসে একসাথে খাবো !”

এই বলে সঞ্জয় আর মৌ বেরিয়ে গেলো ! আর, শৈবাল আর অজয় ডাটা ভালো করে তৈরী করে মডেলকে শেখাতে লাগলো ! ফিরে এসে সবাই মিলে একসাথে খাবার খেলো !

দ্বাদশ পর্ব (শেষ পর্ব) :
পরবর্তী, তিনদিন যত তথ্য ওরা পেলো, সব তথ্যকে দরকার মতো বার করে মডেলকে দিয়ে তাকে বোঝাতে লাগলো !

অবশেষে, তাদের সব তথ্য তৈরী করা সম্পূর্ণ হলো ! এ যেন কর্মযজ্ঞ !

এইবারে, সঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলো – “এইবার কি হবে ?”

অজয় বললো – “এইবার, আমরা শিক্ষণীয় তথ্যগুলো দিয়ে বার দশেক চালাবো যাতে আরও মডেল ভালো করে বুঝতে পারে ! কিছু, ভুল বুঝলে আমাকে অংকের মাধ্যমে সেগুলোকে ঠিক করতে হবে ! তারপর, যখন দেখবো শেষ তিনবারে আমাদের মডেল প্রায় এক ভবিষ্যৎবাণী করছে ! তখন আমরা তৈরী হবো – আসল তথ্য দিয়ে ভবিষ্যৎবাণী দেখার ! এখনো, আগামী দুদিন এতে যাবে !”

শুনে সঞ্জয় একটু হতাশ হলেও মৌ আর শৈবাল বললো – “আরে, সে ঠিক আছে ! ভালো কাজ করছিস ! ধীরে-সুস্থে ঠান্ডা মাথায় করা ভালো ! তুই কর ! আমরা সবাই পাশে আছি !”

শৈবাল আড়ালে সঞ্জয়কে ডেকে বললো – “ভাই, এটা যথেষ্ট জটিল ! ওকে চাপ দিস না ! সবে, বিদেশ থেকে এসে তোর জন্য করছে ! বিদেশ থেকে এই ধরণের গবেষককে আনলে সরকারের প্রচুর টাকা খরচ হয়ে যেত ! ও শুধুমাত্র এইসব কাজ ভালোবাসে, দেশকে ভালোবাসে, তাই বিনা পয়সায় তোদের জন্য করে দিচ্ছে ! আমাদের উচিত ওকে সাপোর্ট করা !”

শুনে তখন সঞ্জয় বুঝতে পেরে বললো – “অসুবিধাটা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার সবাই জড়িয়ে গেছে ! তাই, আমায় প্রতি মুহূর্তে জানাতে বলছে ! কি করি বলতো ?”

মৌ বললো – “ওদেরকে পরিষ্কার করে বল – এইটা একটা জটিল গণনার প্রক্রিয়া ! এতে সময় লাগবে ! কমপক্ষে দশদিন ! আশা করি তার আগে অজয় করে ফেলতে পারবে !”

শৈবাল বললো – “আমি নিশ্চিত ! যেভাবে ও এগোচ্ছে ! হয়ে যাবে !”

সঞ্জয় বললো – “ঠিক আছে ! তাহলে তাই করি ! বলে দি – এই গণনা করতে দশদিন কমপক্ষে লাগবে ! তারপর, দেখা যাবে !”

পরবর্তী পাঁচদিন অজয় প্রায় একা-একা পাগলের মতো কাজ করে গেলো ! বন্ধুদের সাথে শুধু খাবারের সময় দেখা করতো ! ওই তখনই একটু আধটু কথা হতো ! তবে, কেওই কিন্তু ওকে প্রগ্রেস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতো না ! জানে, সেটা করলে ও বিরক্ত হতে পারে ! আর, তার ফল ওর কাজেও পড়তে পারে ! তাই, যতটা সম্ভব বাইরের লোকের কৌতহল, প্রশ্ন সব কিছুই এরাই সামলে দিতো !

অবশেষে, শুক্রবারের রাতে অজয় হাসতে-হাসতে বেরিয়ে এসে বললো – “এবারে মনে হয় আমার মডেল তৈরী ! কাল আমরা আসল তথ্য দিয়ে চালাবো !”

সবাই মিলে জড়িয়ে ধরলো ! সঞ্জয় বললো – “ভাই ! আমার আজ রাতে আর ঘুমই আসবে না !”

শৈবাল বলল – “উফফ ! কি সাংঘাতিক ভালো নতুন জিনিস আমরা দেখতে চলেছি ! “

মৌ বললো – “ওরে তোরা থাম ! আগে বেরোক ! তারপর মজা করবি ! তার আগে আর একটা কথাও নয় এই ব্যাপারে !”

বাকি তিনজন বলে উঠলো – “হাঁ ! একদম ঠিক !”

পরের দিন সকালে সবাই তাড়াতাড়ি করে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট করে নিলো !

এইবার, অজয় এসে ল্যাপটপের সামনে বসলো ! বাকিরা কৌতহল আর আবেগ নিয়ে ওর পাশে বসলো ! প্রচন্ড চাপা উত্তেজনা সবার মধ্যে ঝিলিক দিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে !

একটু পরেই কিছু একটা হবে, যা ভারতবর্ষ কেন হয়তো সারা বিশ্বে এই প্রথম !

এইবার, প্রোগ্রাম চালু হলো আসল তথ্য দিয়ে !

অজয় বললো – “প্রোগ্রামটা হয়তো দেড় ঘন্টা চলবে ! ততক্ষন, আরেক কাপ করে চা হয়ে যাক ? খুব শীত করছে !”

মৌ বললো – “তুই টেনশন করছিস ! তাই তোর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে !”

সঞ্জয় বললো – “দারা ! আনাচ্ছি !”

এরপর, আরও দু-দফা চা খাওয়া হলো ! অবশেষে, সেই সময় উপস্থিত ! প্রোগ্রাম থামলো ! আর, চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে তিনজোড়া “অক্ষাংশ” আর “দ্রাঘিমাংশ” যাকে আমরা “ল্যাটিচুড” আর “লঙ্গিচুড” বলে থাকি ! তার মানে, তিনটে জায়গা !

সঞ্জয় দৌড়ে গিয়ে ম্যাপ আনতে গেলো ! অজয় থামিয়ে দিয়ে বললো – “ধুর ব্যাটা ! গুগল আছে কি জন্য ? এখান থেকেই পেয়ে যাবো !”

গুগলে ওই ডাটা দিয়ে সার্চ করতেই দেখিয়ে দিলো তিনটে জায়গা ! সঞ্জয় – প্রিন্টআউট নিয়ে এলো !

এরপর, অজয় তাতে লাল আর সবুজ কালি দিয়ে গোলের মধ্যে ত্রিভুজ এঁকে দিলো !

উচ্ছাসে তিনবন্ধু ফেটে পড়লো ! কিন্তু, এখনো একটা বড়ো কাজ বাকি !

সঞ্জয় এবারে ওর হাথের ফোন নিয়ে টেলিফোন করলো ইসরোর অপারেশন সেন্টারে ! জানালো – “স্যার, আমরা রেডি লোকেশন নিয়ে ! আপনারা কখন উপগ্রহ দিতে পারবেন ?”

ওদিক থেকে উত্তর এলো – “আর, বারো মিনিট পর উপগ্রহটা ওই অঞ্চলের ওপর দিয়ে যাবে ! তখন আমরা “ডিপ-থার্মাল স্ক্যান” করে জমির প্রকৃতি জানাব ! “

সঞ্জয় ফোনটা রেখে দিয়ে বললো – “আর, বারো মিনিট !”

সবাই কাছে হাথে-হাত ধরে বসে আছে ! এইবার, অজয় যেন উত্তেজনায় কাঁপছে !

ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে ইসরোর থেকে ফোন চলে এলো ! আমাদের স্ক্যান হয়ে গেছে ! আমরা আর দশ মিনিটের মধ্যে আপনাকে ডিটেলস-এ লিখে পাঠাচ্ছি রিপোর্ট !

এ যেন আরো সাসপেন্স ! তখন প্রত্যেকের প্রতিটা সেকেন্ড যেন এক যুগ লাগছে !

সঞ্জয় সাত মিনিট হওয়ার পর থেকেই মোবাইলটা বারবার চেক করতে লাগলো !

ঠিক বারো মিনিটের মাথায় রিপোর্ট এলো ! তাতে বলা আছে – “জমির প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে তিনস্থানে মাটির নিচে কিছু আছে ! এর মধ্যে দুই-জায়গায় পরিমানে বেশি আর অন্য জায়গাটিতে অপেক্ষাকৃত কম !

অজয়ের প্রেডিকশনের সাথে দেখা গেলো – হুবুহু মিলে গেছে !

এইবারে, চার বন্ধু “হুরে” করে চিল-চিৎকার করে উঠলো !

অজয় বললো – “পেরেছি আমরা !”

এর মধ্যে দু-জায়গা ভারতের মধ্যে ও আরেক জায়গা বাংলাদেশের মধ্যে পড়েছে ! আপাতত, ভারতের জায়গা খুঁড়ে সবাই দেখে নিতে চাইছে ! তারপর, কেন্দ্রীয় সরকার সঠিক মাধ্যম দিয়ে বাংলাদেশী সরকারকে তাদের দিকের কথা জানাবে !

এতো এক অবিস্মরণীয় ঘটনা !

ঘন্টা দেড়েক এর মধ্যে ওরা দলবল নিয়ে পৌঁছে গেলো ! সঙ্গে মালদার ডিএসপি ও আরও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী ! সঙ্গে শ্রমিক, যারা খোদাই শুরু করবে যেমনভাবে সঞ্জয় বলবে !

এখনো পর্যন্ত পুরো ঘটনাটা কোন সংবাদপত্রকে জানানো হয়নি ! ঠিক করা হয়েছে তোলার পর তারা জানাবে !

দুপুর দুটো থেকে মাটি খোঁড়া শুরু হলো ! তখন, অজয় বাড়িতে ফোন করে বেশ খানিক্ষন কথা বললো যাতে বাড়ির লোকজন বেশি চিন্তা না করে !

মাঝে-মাঝে চায়ের ভাঁড় চলে আসছে ! এরই মধ্যে ওই জায়গায় পুলিশে পুরো ঘিরে ফেলে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না ! অন্যদিকে, বিএসএফ-কেও বলা হয়েছে যাতে ওপার থেকেও কেও না ঢুকতে পারে !

ঠিক রাত নটা নাগাদ খুঁড়তে-খুঁড়তে ঠঙ করে একটা আওয়াজ হলো ! সঞ্জয় দৌড়ে গেলো – “চিৎকার করে বললো ! এবারে থাম ! সাবধানে খুঁড়তে হবে ! “

কিছুক্ষন খোঁড়ার পর যা বেরিয়ে এলো তার জন্য এতদিন সবাই এতো পরিশ্রমের পরিনাম পেলো – “পাল যুগের এক কলসির মধ্যে সেই যুগের মোহর ! তার সঙ্গে-সঙ্গে নানারকম ছোট-বড়ো মূর্তি যা বহু ধাতুতে গড়া !” এইরকম, আরও গোটা আষ্টেক কলসি ভর্তি প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিস বেরোলো যা কলকাতা জাদুঘরকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করবে !

দুই জায়গা জুড়ে খুঁড়ে যা বেরোলো – তা বলা যেতে পারে বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে হরপ্পা-মহেনজোদারোর পরে সব থেকে বড়ো আবিষ্কার !

আর, সেই আবিষ্কার অন্যতম রূপকার হলো – “টীম অজয়” !

অজয় সব সময় নিজেকে টীম-প্লেয়ার বলে পরিচয় দেয় ! তাই, বাকি বন্ধুরা ওকে শ্রদ্ধাও করে খুব !

বাড়ি যখন ফিরছে – তখন এফএম-এ ওর আবিষ্কার আর ওর জীবনী নিয়ে সবাই চর্চা শুরু করে দিয়েছে !

এর ই মধ্যে ওদের পুরোনো গ্রুপে নতুন লোকেদের টেক্সট ঢুকতে শুরু করেছে ! একটু, পরেই সোজা গ্রুপ কল !

অমর বললো – “ভাই, এইসব করলি কখন ? তুই তো এইসবে ফিরেছিস শুনলাম ! সারা দেশে তো হৈচৈ ফেলে দিয়েছিস !”

মিঠু বললো – “অজয়, সত্যি আজ ভীষণ গর্ব হচ্ছে ! অবশ্য, তোদের সবার জন্যে ! ছোটবেলায় ইতিহাসে পড়েছিলাম – ডক্টর রাধানাথ সিকদারের হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়ো আবিষ্কার ! আর, এই জেনেরেশনের বাচ্চারা তোর নাম স্কুলের বইতে পাবে ! সত্যি কথা বলতে কি আমি তখন ছাত্রদের গর্ব করে বলতে পারবো – যে বিশ্ব-বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবিস্কারক অজয় কর আমার ছোটবেলার বন্ধু !”

অমর বললো – “ভাই, আমার ব্যাংকে একটা একাউন্ট খোল ! তোর সাথে থাকতে পারলে আমাদের সম্মানও বাড়বে ! আর, তাছাড়া, তোর পরবর্তী কোনো এডভেঞ্চার গুলোতে ব্যাঙ্ক তোর কিছুটা আর্থিক ব্যয় বহনও করবে ! ভেবে দেখিস ! যাই হোক, আর জালাবো না আমরা ! তোরা ফিরে আয় ! তারপর কথা হবে !”

অজয় শুধু হেসে ওদের প্রশংসা শুনে গেলো ! কারণ, এখনো সে এতটা তৈরী হয়নি !

শৈবাল বলে উঠলো – “গুরু ! তুমি তো এখন সেলিব্রিটি হয়ে গেলে !”

অজয় বললো – “কি জানি ! তবে আমার একটা কাজ বাকি আছে ! সেটা সম্পূর্ণ করে ফেলি ! “

এই বলেই সে পথে নবদ্বীপের কাছে ফাঁকা মাঠের মাঝখানে গাড়িটাকে একটু দাঁড়াতে বললো !

সবাইকে গাড়ি থেকে নিচে নেমে এলো ! আগে ও পেছনে পুলিশের গাড়ি গুলো থেমে গেছে ! কেও ঠিক বুঝতে পারছে না !

মৌ নেমে এসে বললো – “কি হয়েছে ? নেমে বেরিয়ে এলি ? শরীর খারাপ ?”

অজয় পুরো আমেরিকার ধাঁচে ওই রাস্তায় হাঁটু গেড়ে পকেট থেকে একটা আংটি বার করে মৌয়ের সামনে ধরে বললো – “আমার জীবনের সেরা আবিষ্কার গৌড় নয় ! তুই ! যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমরা কি একসাথে এক হয়ে জীবনে আরও কিছু আবিষ্কার করতে পারিনা ?”

এই দেখে সঞ্জয় আর শৈবালের মুখ দিয়ে সিটি বেরিয়ে গেলো ! পুলিশের লোকজনও তাদের ম্যাডামের প্রপোসাল দেখে প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও, পরে খুব ভালোভাবে মেনে নিলো !

আর ম্যাডাম তখন চোখে জলসমেত বললেন – “বুদ্ধু ! এতো সময় লাগে তোর বুঝতে আর বলতে ! “

“জিও কাকা ! কোনো কথা হবে না !” – এই বলে শৈবাল আরও একটা কানফাটানো সিটি দিলো !

এরপর, পুলিশের এক অফিসার এসে অজয়কে বললো – “স্যার, এবারে আমাদের বেরিয়ে গেলে ভালো হয় ! অনেক রাত হয়েছে, তার ওপর একদম ফাঁকা জায়গা ! খুব একটা সেফ হবে না !”

তখন, আবার সবাই মিলে গাড়িতে উঠে গেলো ! তবে, এবারে অজয় আর মৌ একসাথে পাশে !

আর ঠিক সেই সময়ে রেডিওতে শোনা গেলো – “ভারত সরকার মিত্র-দেশ বাংলাদেশকে বিপুল পাল বংশের খাজনার হদিশ দিয়েছে ! মনে করা হচ্ছে এই পুরোনো সব খাজনা ভারতবর্ষে বার করার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে ! বাংলাদেশ সরকার থেকে ভারতকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়েছে এই বহুমূল্য দেশের সম্পদের কথা জানানোর জন্য ! এতে দুই দেশের মৈত্রী আরো সুগঠিত হলো !”

অজয় বুঝলো – তার এই আবিষ্কারের গুরুত্ব এখন আন্তর্জাতিক হয়ে গেলো ! তবে, আজ তার মনে ভীষণ আনন্দ ও শান্তি ! বাইরের পুরস্কারের থেকেও বড়ো নিজের কাছের পুরস্কার ! আর আজ সেই বিশেষ পুরোস্কারকেই সে জিতেছে !

বিশেষ ঘোষণা :
  • আমার এই গল্পের মূল কাহিনীর সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই ! যদি, কোনো কারণে তা হয়েও থাকে, নিতান্তই কাকতালীয় !
  • এই গল্পের মূল খাজনা যা পাওয়া গেছে সেগুলির ছবি হিসাবে আমি ইন্টারনেটে পাওয়া কিছু ছবি দিয়েছি যাতে গল্প পড়তে সবার আরও ভালো লাগে ! বাস্তবে, এইসব প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ বেশ কিছু বিদেশে চলে গিয়েছে আমাদের দেশ পরাধীন থাকার সময় !
  • এই গল্পে যে ভাবে আমি ভবিষ্যৎবাণী দেখিয়েছি অংকের মাধ্যমে, তা সম্পূর্ণ বৈধ ! বর্তমানে, আমেরিকাসহ বহু দেশে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে !
  • পাল বংশের বিস্তারের ছবি উইকিপেডিয়া থেকে নেওয়া হয়েছে !
  • উপগ্রহ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা ইসরোর ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া যাবে !
  • মেশিন লার্নিং এর ব্যবহার বর্তমান যুগে বিভিন্ন দেশে বহু ক্ষেত্রে বেড়ে চলেছে !
  • আমি গুপ্তযুগের অক্ষর উইকিপেডিয়া থেকে পরে তাকে দিয়ে একটা ধাঁধা বানানোর চেষ্টা করেছি ! পৃকৃত অর্থে আমার এই ভাষা পড়ার কোনো অভিজ্ঞতা নেই ! তাই, ভাষাগত কোনো ত্রুটি থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী !
  • হেনরি ক্রেইটন একজন স্কটিশ নাগরিক, যিনি ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সুবাদে সত্যি বাংলাদেশে পোস্টেড্ ছিলেন ! ওনার গৌড়ের ভগ্নাবশেষ আবিষ্কার হলো অন্যতম সাফল্য ! উইকিপেডিয়া ও ইন্টারনেটে ওনার সম্পর্কে আরো তথ্য পাওয়া যাবে জানতে ইচ্ছা করলে !
  • পাহাড়পুর বুদ্ধিস্ট মনেস্ট্রারিংয়ের ছবি গুগল ম্যাপ থেকে নেওয়া হয়েছে !
আমার গল্প কেমন লাগলো তা এখানে একটা ছোট্ট-কমেন্টস দিয়ে জানালে খুব ভালো লাগবে !

আশা করি আপনারা সবাই ভালো থাকবেন ও সুস্থ থাকবেন !

@কপিরাইট – সাত্যকি দে
Subscribe বোতাম এ ক্লিক করুন আপনার ইমেইল দিয়ে, ও আরো অনেক ছবির সাথে ঘুরতে যাওয়ার গল্প পড়ুন !