প্রথম পর্ব :
ছোটবেলায় প্রায় প্রতি মাসের প্রথম দিনে বাবা মাইনে পাওয়ার সাথে অফিসের কাছে ভালো দোকান থেকে হয় নতুন ধরণের কোনো মিষ্টি, কিংবা নিউ-মার্কেট থেকে ভালো প্যাস্ট্রি বা প্যাটিস নিয়ে বাড়ি ঢুকতেন ! সেটা আমাদের বাড়িতে কিন্তু ভীষণ মজার ছিল ! বলা যেতে পারে ওই দিনটা আমরা অনেকটা ছোট দুর্গাপুজোর মতো মজা করতাম ! আর, দুপুরে ঘরে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে সাদা চৌকো বাক্সে ওর গন্ধ যেন টেনে নিয়ে চলে যেত অন্য দুনিয়াতে ! অনেকটা পুজোতে নতুন জামার গন্ধের মতো মনে হতো ! একটা আলাদা আনন্দ ! তখন, আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি ! সকালের স্কুল ছিল ! সকাল এগারোটার মধ্যে বাড়ি ফিরে খেলতে গেছি ! কিন্তু, মনের মধ্যে খেয়ালটা ঘুরে চলেছে যে আজ বাবার হাথে আমরা আবার প্যাকেট দেখবো ! তাতে নতুন কোনো সুস্বাদু খাবার থাকবে ! দূর থেকে যখনই কাউকে দেখছি হাথে কিছু একটা নিয়ে আমাদের বিল্ডিঙের দিকে আসছে, ভাবছি বাবা হয়তো আসছে ! আবার, অন্যদিকে খেলা ছেড়েও অপেক্ষা করতে মন চাইছে না ! তাই, দোনোমনায় প্রায় দু-ঘন্টা খেলে বাড়িতে ঢুকলাম !

মা বললো – “চট করে স্নান করে নে ! নাহলে বাবু এসে বকবে !”

আমাদের বাড়িতে এই জিনিসটা ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, বাবা সবাইকে সকাল-সকাল স্নান করে নিতে বলতেন ! বলতেন – “সকালে স্নানটা করে নিয়ে তোরা সারাদিন যা ইচ্ছে কর ! কেও আর কিছু বলবে না ! তাতে, সুবিধা এটা যে যখন তোর খিদে পাবে বা অন্য কিছু করতে ইচ্ছে করবে, সেটা তখনই শুরু করতে পারবি ! স্নানের জন্য সেটা দেরি হবে না !”

তখন কথাগুলো না বুঝলেও এখন বুঝি ! হয়তো এটাকেই – “টাইম ম্যানেজমেন্ট” বলে !

আমি তাই আর দেরি না করে ঢুকে গেলাম মন না চাইলেও ! হঠাৎ মনে হলো দরজাতে টোকা পড়লো ! আমার বাবার বিশেষ একটা কড়া নাড়ার ধরণ ছিল, যেটা অন্য কেও করতো না ! তাই, খুব সহজেই আমরা সবাই বুঝে যেতাম যে বাবা ফিরে এসেছে ! তাই, এক্ষেত্রেও আমার বুঝতে বাকি হলো না যে বাবা বাড়ি ফিরেছেন !

আমি কোনোরকমে স্নান করে নিয়ে বেরিয়ে দেখি বাবা এসে জামা-কাপড় ছেড়ে সবে খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছেন ! মা দইয়ের ঘোল ঠান্ডা বরফ-কুচি দিয়ে খেতে দিয়েছেন ! যাতে শরীরটা একটু ঠান্ডা হয় ! তখন তো আর আজকের দিনের মতো ফস-ফস করে ফ্রীজের ভেতর থেকে কোল্ড-ড্রিঙ্কস খুলে বার করে খাওয়া হতো না ! আর, তাছাড়া দইয়ের ঘোল শরীরের কোনো ক্ষতিও করে না ! আশে-পাশে আজ কিন্তু কোনো প্যাকেট দেখছি না !

বাবা ব্যাগ খুলে আমার জন্য নতুন স্টিকারের লেবেল নিয়ে এসেছেন স্কুলের খাতায় লাগানোর জন্য ! কদিন আগে আমি ঘুরে এসে একটা বাংলায় ঘোরার অভিজ্ঞতা লিখেছিলাম ! তখন বলেছিলেন – “ঠিক আছে ! এই মাসটা যাক ! মাইনে পেলেই আমি কিনে দেব !”

তার থেকে বুঝলাম – “মাইনে চলে এসেছে !”

মনে-মনে ভাবলাম – “মাইনে হয়ে গেছে ! অথচ কোনো প্যাকেট নেই ! কিন্তু, ঘরে একটা ঘির গন্ধ ঘুরছে ! ঠিক যেমন গাওয়া ঘি দিয়ে তৈরী কিছু !”

মাকে চুপি-চুপি জিজ্ঞাসা করলাম – “কিগো দাও !”

মা বললো – “দারা, ভাতটা হচ্ছে ! হতে দে ! তারপর দিচ্ছি ! ততক্ষন, ওই ছোট গ্লাসটায় তোর জন্য একটু ঘোল রেখে দিয়েছি ! ওটা চট করে খেয়ে নে !”

এমনি সময়ে – আমায় দইয়ের শরবত বা ঘোল দিলে লাফাতে-লাফাতে খেয়ে নিতাম আনন্দের সাথে ! কিন্তু, খানিকটা হতাশ হয়ে চুপ করে গিয়ে গ্লাসটা নিয়ে গিয়ে বাবার কাছে গিয়ে বসলাম !

গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম – “বাবু ! তুমি কখন এসেছো ? তোমার হাত টিপে দি ! হাত ব্যাথা হয়ে গেছে ?”

বাবা মুচকি হেসে বললেন – “না ! হাত টিপবি কেন ? ভারী কিছু নিয়ে এলে ব্যাথা হবে ! আজতো ব্যাথা নেই !”

আমি এবারে আরো খানিকটা হতাশ হয়ে – “ও” বলে মাথা নিচু করে শরবতটা খেয়ে নিলাম ! “কিন্তু, ঘরের মধ্যে ওই গন্ধটা কিসের ? ” – জিজ্ঞাসা করলাম এবারে !

বাবা বললেন – “কোন গন্ধ ?”

এরই মধ্যে মা ঘরে ঢুকেছেন কিছু করতে, বললেন – “ওত আমি আজ গাওয়া-ঘি কিনেছি, তুই দেখিস নি বিক্রি করতে এসেছিলো ?”

তখন মনে হলো – “হাঁ ! তাও তো ঠিক ! আমি একজন বয়স্ক মহিলাকে চিনি, যিনি প্রতি মাসে জয়নগর থেকে আমাদের এলাকায় গাওয়া-ঘি বিক্রি করতে আসেন !”

এইবারে, মনটা বেশ হতাশ হয়ে গেলো ! আর, কিছু কথা না বাড়িয়ে নতুন কেনা ফেলুদার বইটা পড়তে শুরু করে দিলাম !

দুপুরে, মায়ের হাথের কচি-পাঁঠার মাংস খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলাম !

দ্বিতীয় পর্ব :
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে খেলতে বেরিয়ে গেলাম ! ঘন্টা দুয়েক ফুটবল খেলে বাড়ি ফিরে জামা-কাপড় পাল্টে গা ধুয়ে ঘরে বসলাম ! এইবার, পড়তে হবে ! ইতিহাস বইটা নিয়ে সবে বসেছি ! গুপ্ত-সাম্রাজ্য নিয়ে পড়তে হবে ! ঠিক সেই-সময়ে মা ঘরে বিকেলের খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো ! দেখি সাদা ফুলকো-লুচি, সঙ্গে মায়ের হাথের সাদা-আলুর তরকারি ! আর, তার পাশে একটা ছোট্ট বাটিতে এক নতুন ধরণের “বোঁদে” ! বোঁদে আমি অনেক খেয়েছি ! কিন্তু, এটা যেন সম্পূর্ণ আলাদা ! এক-একটা দানা প্রায় আঙুরের মতো ! বাইরেটা খটখটে শুকনো ! গা দিয়ে গাওয়া ঘির গন্ধ বেরোচ্ছে – যা সকালে পাচ্ছিলাম ! এখন, আর বুঝতে বাকি রইলো না যে সকালে সবাই মিলে আমার কাছে এটা চেপে গেছে !

তাকিয়ে দেখি – সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে ! তখন, যেন আর মনের আনন্দটা চেপে রাখতে পারছিলাম না !

বললাম – “ও ! তাই ভাবি এতো সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে কোথা থেকে ?”

কিন্তু, সেটা কেন এতো দুর্লভ বুঝলাম খাওয়ার ঠিক পরেই !

একটা দানা মুখে দিতেই বুঝলাম ! বাইরেটা গাওয়া-ঘির আর অল্প মিষ্টির একটা শুকনো আস্তরণ ! কিন্তু, যেই দাঁতে কামড় দিলাম, সঙ্গে-সঙ্গে গাওয়া-ঘির গন্ধ সমেত মিষ্টি রস সারা মুখের মধ্যে ফোয়ারার মতো ছিটকে বেরিয়ে এলো ! আর, তার অভিজ্ঞতা ও স্বাদ যেন অসাধারণ ! কয়েকটা শব্দে সেটা হয়তো বোঝানো যাবে না !

একটা-একটা করে খাচ্ছি আর প্রায় সেই আনন্দটা আরো বহুগুনে বেড়ে চলেছে !

নিমেষের মধ্যে শেষ করে মাকে আরেকটু চাইলাম ওই বোঁদে !

মা বললো – “ঠিক আছে ! আরেকটু দিচ্ছি ! তবে, এরপর আর চাইবে না ! একদিনে সব খেতে নেই ! শরীর খারাপ করবে ! আর, তাছাড়া বাবু সবার জন্য এনেছে ! সবাইকে দিয়ে খেতে হবে !”

মায়ের কথায় – “হাঁ-তে-হাঁ” মিলিয়ে আরেকটু নিয়ে নিলাম ! উফফ ! “কি অসাধারণই না খেতে ! যদি, আমার একটা ঘর থাকতো, যেখানে একটা বোয়াম থেকে শুধু এই বোঁদে আর অন্য পাত্র থেকে মায়ের তৈরী লুচি যদি চাইলেই এসে যেত ! তাহলে, কত্ত ভালো হতো ! যদি “গুপী-বাঘার” মতো আমাকেও “ভুতের-রাজা” খাওয়ার বড়টা দিতো, আমি হয়তো এই দুটো খাবারই চেয়ে যেতাম ! আর, কিছু লাগতো না !”

তখনকার মতো খেয়ে উঠে হাত ধুয়ে পড়তে বসলাম ! কিন্তু, মাথার মধ্যে বোঁদে আর তার গন্ধ ঘুরে-বেড়াতে লাগলো !

তৃতীয় পর্ব :
এই অবস্থায় আর কি মাথায় “গুপ্ত-সাম্রাজ্য” ঢোকে ? অনেক কষ্টে পড়ায় মনটা বসিয়েছি ! এর, মধ্যে দেখি মা একটা নতুন কেনা এয়ার-টাইট এলুমুনিয়াম বোয়াম আমাদের কাঠের আলমারির পেছনে রেখে দিলো নিচের তাকে ! তার সামনে অনেক গুলো কাঁচের শিশি রাখা আছে, যাতে মায়ের হাথে ঘরে তৈরী আচার রাখা আছে ! কাজেই ওই অ্যালুমিনিয়াম বোয়াম বার করতে হলে খুব সাবধানে কাঁচের শিশি বার করতে হবে ! শিশিগুলো রেখে বার করতে গেলে ওপরের যা ফাঁকা জায়গা আছে, একটু গন্ডগোল হলেই সামনের শিশিগুলো পরে গিয়ে ভেঙে যেতে পারে !

আর প্রশ্ন হচ্ছে – “ওই বোয়ামে কি এমন আছে যার জন্য ওটাকে পেছনে রাখা আছে ? কোনো বিশেষ কিছু ? মানে আমি যা ভাবছি সেটা কি ?”

যেভাবে মা রাখলো – “তাতে আমি এখন অনেকটাই নিশ্চিত ! ওতে রাখা আছে সেই বিখ্যাত বোঁদে !”

মাকে জিজ্ঞাসা করলাম – “ওটাতে কি গো মা ?”

মা বললো – “ওই লুচির করা একটু ময়দা থেকে গিয়েছে ! ওটা ! এটা খুলিস না কিন্তু, ঠিক মতো কৌটো না লাগাতে পারলে ময়দা নষ্ট হয়ে যাবে !”

আমি মনে-মনে ভাবলাম – “ময়দা ? বোঁদে নয় ? তাহলে, বললো কেন যে সবাইকে দিয়ে খেতে হবে ? কেমন যেন হিসাবে আবার মিলছে না !”

যদিও আমি – “ও” বলে আর কথা বেশি বাড়ালাম না !

কিন্তু মনের মধ্যে একটা খোঁচা কিন্তু রয়েই গেলো !

প্রথম, পড়াটা মুখস্ত করে মাকে বললাম ! এর মধ্যে বাবা মাকে আরেক কাপ “চা” বানাতে বললেন ! মা আমাকে লিখতে বলে দিয়ে রান্নাঘরে গেলেন স্টোভে চা বানাতে !

আমি জানি আমার লিখতে অন্তত দশ-মিনিট লাগবে ! ততোক্ষণে, মা হয়তো চা বানিয়ে চলে আসতে পারবেন !

তাই, আমিও লেখা শুরু করে দিলাম !

দ্বিতীয় অনুচ্ছেদটা সবে শেষ করেছি ! এর মধ্যে কারেন্ট চলে গেলো ! আজকের কলকাতার বাচ্চারা হয়তো এটা বুঝবেনা ! কিন্তু, আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে সন্ধ্যেবেলায় কারেন্ট চলে যাওয়াটা কোনো অবাক করা নতুন ঘটনা নয় !

একবার চলে গেলে ঘন্টাখানেকের আগে কিন্তু তার দেখা পাওয়া যেত না ! সেই সময়ে বাড়িতে মা বা পাশের বাড়ির কাকু-কাকিমার সাময়িক পড়ার বিরতি দিতেন !

আমরা সব ছোটরা বাইরে বেরিয়ে, একজোট হয়ে – সেই অন্ধকারে ভুতের গল্প করতাম বা কোনো বড়ো কাকুরা আমাদের শোনাতেন ! সেটাও কিন্তু ভীষণ মজার আরেক অভিজ্ঞতা ছিল !

আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে আপাতত ঘন্টাখানেকের জন্য পড়তে হবে না !

তাহলে কি বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারবো নাকি ওই নতুন কৌটের লুকানো খাজানার হদিশ বার করবো !

তারপর, ভাবলাম – “রোজ-রোজ তো গল্প করি, আজ তাহলে ওই কৌটোতে কি আছে সেটাই বার করি !”

চতুর্থ পর্ব :
মা রান্নাঘর থেকে কারেন্ট চলে যেতেই বললো – “কেও নড়ো না নিজেদের জায়গা থেকে ! মোমবাতিটা ফুরিয়ে গেছে ! আমি চিমনিটা একটু পরিষ্কার করে কেরোসিন ভরে নিয়ে আসছি ! একটু সময় দাও !”

আমি বুঝলাম – আমার কাছে আরো খানিকটা সময় চলে এলো ! ধরতে গেলে পনেরো-মিনিটের মতো !

আমি ঠিক বিড়ালের মতো আসতে-আসতে খাট থেকে নেমে কাঠের আলমারির কাছে এসে বসলাম ! এর পরের পর্বটা আরো কঠিন ! কারণ, ওই আলমারির দরজা খুলতে গেলেই – “পুরোনো ভুতের বাড়ির দরজা খোলার মতো আওয়াজ হয় !”

সেই আওয়াজ যাতে না হয়, তার জন্য আমি পাল্লাটাকে নিচ থেকে ওপরের দিকে ঠেলে একটু-একটু করে খুলতে লাগলাম ! একটু আওয়াজও যাতে না হয় !

এইবার, দরজাটা প্রায় অর্ধেকটা খুলে ফেললাম কোনো আওয়াজ না করে ! দরজাটা একটা-পা দিয়ে আটকে রেখে এইবারে অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে-হাতড়ে সামনের দিকের কাঁচের বোতলগুলো ধরে – তাদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলাম ! আর, তারপর হাতটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে – সেই বোয়ামটার নাগাল পেলাম ! হাত দিয়ে খানিকটা ওই বোয়ামের উচ্চতা মাপার চেষ্টা করলাম ! এটা খুব দরকারি ! কারণ, ওটা বুঝতে পারলেই, আমি কাঁচের শিশিগুলোর ওপর দিয়ে ওই ভারী বোয়ামটা আদেও আনতে পারবো কিনা, তা বুঝে যাবো !

হাত দিয়ে যতটা অনুভব করলাম, মনে হলো হয়তো পারবো ! তারপর, দ্বিতীয় হাতটাও সাবধানে ঢুকিয়ে কাঁচের-শিশি বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করে বোঝার চেষ্টা করলাম কতটা ভারী ! আদেও, আমি তুলে নিয়ে আসতে পারবো কিনা !

মনে হলো – পারব ! কিন্তু, খুব সাবধানে করতে হবে ! কারণ, একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই – হয় ওই ভারী কৌটোটা কাঁচের-শিশির ওপর পরে গিয়ে আওয়াজ হবে, নাহলে – সামনের দিকের কাঁচের শিশিগুলো পরে যাবে আলমারি থেকে মাটিতে !

দুটোর কোনোটাই আমি চাই না !

তোলার সময় বুঝতে পারলাম কত্ত কঠিন ওই কাজটা ! যেহেতু, ওই ভারী বোয়ামটার শুধু সামনের দিকটাই ধরতে পেরেছি ! বাকি কৌটোটার অধিকাংশ দিকটা খানিকটা পেছনের দিকে ঝুলে আছে ! আর, সেই জন্য আমার ছোট হাথের কব্জিতে বেশ চাপ লাগছে ! সেটা বেশ ব্যাথা দিচ্ছে মাংসপেশিতে ! কিন্তু, সবাই তো জানে – “কষ্ট না করলে – কেষ্ট মেলে না !”

সেই মন্ত্র নিয়ে আমি এগিয়ে চললাম ! এ যেন এক সাংঘাতিক গোপন-যুদ্ধ ! এই মিষ্টি-যুদ্ধে হেরে যেতেও চাই না !

একবার যেন মনে হলো কৌটোটা প্রায় আলমারির তাকের ওপরের ছাদে লেগে গেলো ! কিন্তু, আমার একটু-একটু করে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো আওয়াজ হলো না !

তারপর, সেই সময় এলো – যখন কৌটোটা আমি স্বার্থকভাবে বার করতে পারলাম ! এইবার, খোলার পালা !

পঞ্চম পর্ব :
কৌটোটা হাথে নিয়ে খুলতে গিয়ে বুঝলাম আমার জন্য আরও বড়ো কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছে !

কৌটোটার ঢাকনা এতটাই শক্ত, যে খুলতে গেলেই একটা বড়ো আওয়াজ হবে যেমন এয়ার-টাইট কৌটোতে হয় ! কাজেই, সেটাও চলবে না !

এবারে, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো ! একবারে, পুরো ঢাকনাটা না খোলার চেষ্টা করে, চারিদিক ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে একটু-একটু করে ওপরের দিকে ঢাকনাটাকে তুলতে থাকলাম ! একটা সময়ের পর একদিকে সামান্য একটু হাওয়া ঢুকে যাবে ! তাতে, ভেতরের চাপটাও অনেকটা কমে যাবে ! আর, খুলতে গেলে আওয়াজও তেমন হবে না !

এইভাবে, খুলতে শুরু করে দিলাম ! এইবার, কিন্তু বেশ সহজেই একটু-একটু করে খুলতে শুরু করলো ! আওয়াজও হচ্ছিলো না ! ঠিক একটা সময়ের পর একদিকে একটু ছোট্ট ফাঁক হতেই খুব ছোট্ট একটা আওয়াজ হলো ! আর, তার সঙ্গে গাওয়া ঘির গন্ধে ভোরে গেলো ! বুঝলাম, আমি ঠিক ! এক কৌটো বোঁদে আমার জন্য হাতছাড়া দিচ্ছে !

ইতিমধ্যে মাও রান্নাঘরে চিমনি পরিষ্কার করে বললো – “তেল ভরে নিয়ে আসছি ! আর মিনিট পাঁচেক দাও !”

হয়তো মায়ের চিমনি পরিষ্কারের আওয়াজে ঘরের এই আওয়াজটা দিদি আর বাবা ঠিক বুঝতে পারলো না !

তবে আমার হাথে আর বেশি সময় নেই ! খুব তাড়াতাড়ি খুলে একমুঠো মুখে পুড়ে দিতে হবে !

আসতে-আসতে পুরো ঢাকনাটা খুলে গেলো ! খুব সাবধানে ঢাকনাটাকে পাশে রেখে দিলাম ! ব্যাস, এতো পরীক্ষা, কৌশল – সব কিছুর অবসান ! আমার হাথের মুঠোতে পাঁচ-থেকে ছ-টা বোঁদের দানা !

এতক্ষনে, ঢাকনাটা খুলে পাশে রাখার ব্যাস্ততায় একটু খেয়াল করিনি যে মা চিমনি ধরিয়ে নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে ! দরজার গায়ে আলোটা হঠাৎই দেখলাম বড়ো হয়ে গেছে !

তার মধ্যে সবে মুখের সামনে দুটো দানা ধরে ঢোকাতে যাবো – মায়ের ঘরে প্রবেশ ! তার থেকেও যেটা সব থেকে বড়ো – কারেন্ট চলে এসেছে !

হঠাৎ, কারেন্ট যে আমার সাথে এইভাবে বেইমানি করে দেবে ভাবতেই পারিনি ! বেশ খানিকটা থতমত খেয়ে ওই একই ভাবে আমি অনেকটা স্ট্যাচু হয়ে গেছি !

আর, তখন সবার চোখ আমার দিকে ! আমার হাথের সামনে ধরে রাখা বোঁদে, তার পাশে রাখা কৌটো, ও তারও পাশে রাখা ঢাকনা ! আর, আমার ছোট্ট হাঁ করা মুখ ওই বোঁদের দিকে তাকিয়ে ! অনেকটা, আগেকার দিনে রাজা-মহারাজারা যেভাবে আঙ্গুর খেতেন – ঠিক সেইভাবে !

আচমকা, পুরো ব্যাপারটায় আমি একদিকে যেমন অপরাধ বোধে জর্জরিত, তেমনি লজ্জা, আর বকা খাওয়ার ভয়ে – খানিকটা কাঁদো-কাঁদো গলায় বললাম – “বোঁদে !”

ব্যাস ! বাড়ির সবাই এক সাথে হো-হো করে হেসে উঠলো !

মা বললো – “দেখেছো ! কাঁচের শিশির পেছনে রাখলাম ! তুই কি করে তুলে আনলি ওগুলোকে না সরিয়ে ?”

দিদি বললো – “মা ! তুমি তো এয়ার-টাইট বোয়ামে রাখলে ! ও খুললো কি করে ? কোনো শব্দ পাইনি তো !”

মাও অনেকটা অবাক হয়ে গেলো সেটা ভেবে !

বাবা হেসে বললো – “আচ্ছা ! ওকে আরেকটু দাও !”

মা জানতো আমি এমনি না জানিয়ে কখনো কিছু করতাম না ! শুধু, মিষ্টি এলেই একটু গন্ডগোল !

তাই, মা আর কথা না বাড়িয়ে বোয়ামটা আমার কাছ থেকে নিয়ে আরেকটা ছোট্ট বাটিতে আরো কয়েকটা বোঁদের দানা দিয়ে বাবাকে বললেন – “নব-গুইয়ের বোঁদে যে তোমার ছেলেকে এই কাজ করাবে, তা আমি ভাবিনি !”

এইবারে, আমি প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে সোফার পেছনে মুখ লুকিয়ে খানিক্ষন বসে রইলাম ! হাথে অবশ্য বাটিটা থেকে গিয়েছে ! আর, কিছুক্ষন, পর-পর একটা করে দানা আমার মুখে চালান হচ্ছে !

তাই, আমার ওই মিষ্টির অভিযানকে “সার্থক মিসএডভেঞ্চার” বলতে পারি !

বিশেষ ঘোষণা :
  • সমস্ত ছবি আমার নিজের তোলা – এই ছবির সাথে গল্পের চরিত্রের কোনো মিল নেই ! নেহাৎ প্রচ্ছদের কারণে প্রতীকী হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে !
আমার গল্প কেমন লাগলো তা এখানে একটা ছোট্ট-কমেন্টস দিয়ে জানালে খুব ভালো লাগবে !

আশা করি আপনারা সবাই ভালো থাকবেন ও সুস্থ থাকবেন !

@কপিরাইট – সাত্যকি দে
Subscribe বোতাম এ ক্লিক করুন আপনার ইমেইল দিয়ে, ও আরো অনেক ছবির সাথে ঘুরতে যাওয়ার গল্প পড়ুন !