প্রথম পর্ব :
ছুটি বলতে গেলে সবাই কোনো না কোনো ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে ! আমি কিন্তু আজ সম্পূর্ণ অন্য ধরণের কয়েকটা অভিজ্ঞতা বলবো যার পরিপাক পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা হলেও, তার স্বাদ কিন্তু কোনো অংশে কম যায় না !

ছোটবেলার ছুটি মনে করতে গিয়ে আমার কয়েকটা বিশেষ ছুটির ঘটনা মনে পরে ! এক হলো গরমে স্কুল ছুটি ! আর, দ্বিতীয়টা হলো শরৎ-কালে দূর্গাপুজোর ছুটি ! এছাড়া, বেশ কয়েকবার অপ্রত্যাশিত বর্ষাকালে একদিনের ছুটি পাওয়া যেত, যেগুলো যথেষ্ট মনে আনন্দের দাগ কেটে গেছিলো ! আর, সব থেকে পরের বড়ো ছুটিটা হতো খ্রীষ্টমাস আর নতুন বছরের সময়কে ঘিরে ! এইরকম চারটে অন্যরকম ছুটির ঘটনা আজ আমি বলতে চাইছি ! 

দ্বিতীয় পর্ব – গরমের ছুটি :
গরমের সব থেকে মনে রাখার মতো যে ঘটনাটা স্কুলের সব বন্ধুদেরকে মাতিয়ে রাখতো – তা হলো গরমের ছুটি ! নববর্ষের পর থেকে প্রায় টানা তিনমাস পড়াশোনা করার পর অত্তন্ত গরমে এই ছুটিটার জন্য আমরা সবাই “হাঁ” করে বসে থাকতাম ! দীর্ঘ একমাসের ছুটিতে অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেত – বাঙালির প্রিয় গরমে ভ্রমণের জায়গা হয় দার্জিলিং, নাহয় তো সিমলা, কুলু, মানালি বা কাশ্মীর ! অর্থাৎ, শরীরটাকে একটু ঠান্ডা করে রাখা ! নতুন করে অক্সিজেনের যোগান দেওয়া ! আর, যারা বাড়িতে থাকতেন – তাদের জন্য এইসময়ে ছিল বাঙালির অন্যত্তম প্রিয় ফল আমের আবির্ভাব ! খুব স্বাভাবিক ভাবে বাজারে বিভিন্ন রঙের ও সুগন্ধি আমের গন্ধে মো-মো করতো ! হিমসাগর, আম্রপালি, ল্যাংড়া আরো কত কি ! কোনোটার আঁটি আছে, কোনোটার ছোট আঁটি ! আবার কোনোটায় সাঁস আছে – কোনোটায় নেই ! সত্যি কথা বলতে কি – ছোটবেলায় গরমের ছুটিতে দুপুরবেলায় আম বা লিচু বা জামরুল বা ঠান্ডা তরমুজ দিয়ে সময়টা যে কিভাবে কেটে যেত – তা বলে বোঝানো যাবে না ! তার সঙ্গে বাইরে বেরোলে ডাবওয়ালার ছোট সাইকেল গাড়ি থেকে কচি ডাবের জল খেয়ে তৃষ্ণা মেটানোর পরিতৃপ্তিটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না !  কি আনন্দই না পেতাম ! তার সঙ্গে-সঙ্গে যুক্ত হলো নতুন সংযোজন ! ব্যাপারটা তাহলে একটু খুলেই বলি ! সেটা হলো – ক্লাস সেভেন-এ পড়ি তখন ! একটাই টিভি চ্যানেল সর্ব সাকুল্লে ! কলকাতা দূরদর্শন ঘোষণা করলো – গরমের ছুটি উপলক্ষে ছোটদের জন্য দুপুরবেলায় নতুন অনুষ্ঠান প্রতিদিন এক-ঘন্টা করে হবে ! তার নাম – “ছুটি-ছুটি” ! তাতে, ছোটদের জন্য তৈরী নানা অনুষ্ঠান ও একটা সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র দুদিনে দুটো ভাগে দেখানো হবে ! অনুষ্ঠানটার শুরু হবে -সত্যজিৎ রায়ের “সোনার কেল্লা” সিনেমা দিয়ে ! সত্যি কথা বলতে কি আনন্দের যেন সিমা ছিল না ! তখন তো আর আজকের মতো চব্বিশ-ঘন্টার বাংলা চলচ্চিত্রের চ্যানেলও ছিল না ! আর ইউটুবতো দূর অস্ত ! তাই, এর থেকেই বুঝতে পারছো – ওই এক ঘন্টার অনুষ্ঠানই কতটা সবাইকে আনন্দ দিতে পারতো !

যেদিন, অনুষ্ঠানটা শুরু হবে – সেদিন সকালে তাড়াতাড়ি পড়াশোনা করে নিয়ে স্নান করে নিলাম ! কি ভীষণ চাপা উত্তেজনা ! এমনি ফেলুদা আমার অত্তন্ত প্রিয় ! তার ওপরে সবথেকে বড়ো এডভেঞ্চার মুভি ! সত্যি কথা বলতে কি – যারা ঘুরতে যেতে পারতো না যেকোনো কারণেই হোক, তাদের জন্য এই অনুষ্ঠান কিন্তু ঘুরতে যাওয়ার থেকে কোনো অংশে কম ছিল না ! ওই ফেলুদার – “দুস্টু লোক”-কে ধাওয়া করতে গিয়ে কখনো ট্রেনে বা কখনো গাড়িতে দেশের মধ্যে এক শহর থেকে অন্য শহরে দাপিয়ে বেড়াটা যেন আমাদের মনের আশা আখাঙ্কাকে মেটাতে সাহায্য করেছিল ! ঠিক যেন আমি তোপসে হয়ে ফেলুদার সঙ্গে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি রহস্যের সমাধানে ! এটাই বা কম কি ? আর, সেই জন্য সেবারের গরমের ছুটিতে কোথাও না বেড়াতে গিয়েও তার অভাব সম্পূর্ণভাবে পূরণ হয়েছিল – অন্তত আমার জন্য তো বটেই ! 

তৃতীয় পর্ব – বর্ষায় আচমকা ছুটি :
কেমন লাগবে যদি এক ঘেয়ে জীবনে হঠাৎ একটু পরিবর্তনের হাওয়া লাগলে ? যেটা সাময়িক সব অসহ্য যন্ত্রণাকে ভুলিয়ে দিয়ে এক পশলা শীতের মধুর মুহূর্ত দিয়ে যায় ? তাই, অত্যন্ত গরমে যখন সবাই ভীষণ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত – ঠিক তখন এক পশলা ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি কিন্তু সবাইকে আসস্ত করে ! আর, সেই বৃষ্টি যদি স্কুল যাওয়ার সময়ে হয় ? তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই ? যাকে বলে – “সোনায় সোহাগা” !

ঠিক এইরকম এক প্রচন্ড আদরের বর্ষার দিন মনে আছে ! আগের দিন খবরে নিম্নচাপের কথা শুনে মনে একটু আশা ছিল ! যদি বৃষ্টিটা স্কুলের সময়ে আসে ! উফফ ! তাহলে আর কোনো কথা হবে না ! একদিনের জন্য ওই স্কুলের ইতিহাস টিচার এর মুখস্থ আওড়ানোর হাত থেকে তো বাঁচা যাবে ! আর, সেই সঙ্গে প্রাণ ভোরে উপভোগ করবো ! সাধারণত, আমার আশা – আশাই থেকে যায় ! তবে, কেন জানি সেইবার তুমুল বৃষ্টি হলো ভোররাত থেকে ! এতটাই হলো যে আমার আশাতীত বললেও কম বলা হবে ! সকাল সাড়ে আটটায় যখন দেখলাম ঘুটঘুটে অন্ধকার, পাশের বিল্ডিংটাও ঠিক করে দেখা যাচ্ছে না, রাস্তার লাইট গুলো জ্বলছে – তখন আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে আজ আর আমায় যেতে হবে না ! কারণ, অন্যদিনে এই সময়ের মধ্যে আমার স্নান হয়ে গিয়ে খাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে যাই ! ঠিক সকাল আটটা পঁয়তাল্লিশ-এ একটা বাস থাকে, তাতে করে স্কুল যেতে হয় ! আজ, সেই সময়ে পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন বাড়ির কেও কিছু বললো না – তখন বুঝে গেলাম আজ বর্ষা স্পেশাল ! আজ ছুটি !

ভেবেই মনটা কয়েকগুন আনন্দে ভোরে উঠলো ! কিছুক্ষনপর, এই সকাল দশটা নাগাদ পাশের এপার্টমেন্টের দুই কাকু এসে বাবাকে জানালেন অত্যন্ত বৃষ্টির জন্য আজ আমাদের বিল্ডিঙের সবাই পিকনিক করতে চাইছেন ! আয়োজনে, ইলিশ আর খিচুড়ি ! সঙ্গে কিছু ভাজাভুজিও থাকবে লাবড়া ছাড়া ! এতো মেঘ না চাইতেই জল ! বাবাও রাজি হয়ে গেলেন মায়ের সাথে কথা বলে ! এর মানে, আজ আর নো পড়া ! আর, বাবারা কয়েকজন মিলে ওই বৃষ্টির মধ্যে ছাতা নিয়ে ইলিশ মাছ আনতে বেরিয়ে গেলেন ! আর, মাও পাশের বাড়ির দুই কাকিমার সাথে আমাদের বাড়িতে এসে রান্নার সব আয়োজন একসাথে করতে থাকলেন ! আমাদের বিল্ডিঙের এটাই সব থেকে ভালো ! কোনো কিছুতেই সবাই হৈ-হৈ করে একসাথে জুড়ে গিয়ে সেলেব্রেট করে !

আমাদের খড়খড়ি দেওয়া জানলা ! তা দিয়ে বৃষ্টির ক্রমাগত মোটা-মোটা ফোঁটা পড়তে দেখছি ! তার সঙ্গে মাটির সোঁদা গন্ধ যেন এক অন্য জগতে নিয়ে চলে যায় ! এ এক অদ্ভুত গন্ধ ! মনটা ভরে যায় ! তার ওপরে আমাদের নতুন কেনা ফিলিপ্স টেপে বাবা চালিয়ে দিলেন – “ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস” – গানটি ! সব মিলিয়ে নস্টালজিয়ার ঠাকুরদাদা হয়ে সারা জীবনের মতো মনের মধ্যে গেথে রইলো !

আর, দুপুরে ওই তুমুল বৃষ্টির আওয়াজের মধ্যে সবাই মিলে পাত পেড়ে গরম-গরম খিচুড়ি, সাথে ডিম্ ভাজা, আলু ভাজা, বেগুন ভাজা, পাঁপড় আর ইলিশ মাছ ! সাথে স্পেশাল ভাদোয়া ঘি ! সত্যি, আর কিছু চাই না ! আজও বৃষ্টি পড়লে সেই দিনটার কথা মনে পড়ে ! আজ হয়তো তাদের মধ্যে অনেকেই আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু স্মৃতিটা আজও অক্ষত হয়ে রয়ে গিয়েছে !

চতুর্থ পর্ব – দুর্গাপুজো :
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের জীবনে অন্যতম বড়ো অনুষ্ঠান হলো দুর্গাপুজো ! আর, প্রকৃতিও যেন সেইভাবে নিজেকে তৈরী করে তোলে ! সত্যি কথা বলতে কি মহালয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই যেন মনটা উরু-উরু করতো ! তার সঙ্গে শরতের নীল ঝকঝকে আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, মাঠে ফুটে ওঠা নতুন কাশফুল দেখলেই পড়াশোনা কপালে উঠতো ! আর, সেই সময় থেকে মাও অনেকটা ছাড় দিয়ে দিতেন ! অন্য সময়ের মতো এত কড়াকড়ি থাকতো না ! বরং, একটু আগে খেলতে বেড়াবো বললেও – তার সম্মতি খুব অনায়াসেই পাওয়া যেত !  এর মধ্যে অনেকেই তাদের পুজোর বাজার প্রায় শেষ করে ফেলেছেন বা শেষের দিকে ! এখন, শুধু সময়ের অপেক্ষা ! মাঝে-মাঝে আলমারি থেকে মা যখন পাশের বাড়ির কাকিমারা এলে দেখাতেন, তখন টুক করে জামাটা তুলে নতুন জামার গন্ধ শুকতে আরো উত্তেজনা হতো ! 

মহালয়ার আগের দিন পাড়ায় দোকানের থেকে আমাদের রেডিওটা একবার চেক করে নেওয়া হতো ! আর, সঙ্গে নতুন এভেরেডির ব্যাটারী কিনে আনা হতো ! আর, তার সঙ্গে নানানরকম স্নাক্স, বিস্কুট, নিমকি, চানাচুর ও আরো অনেক মুখরোচক খাবার ! সাধারণত, এই সময়ে পাড়ায় মাইকটা লাগানো হয়ে যেত !

আমাদের বাড়িতে একটা বিশেষ রীতি ছিল ! এটা অবশ্য আমার মাই চালু করেন ! মহালয়ার দিন ভোর চারটেয় সবাই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বসে রেডিওতে শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের মহালয়া অনুষ্ঠানটি শুনবে ! সাধারণত, বাড়িতে কেবলমাত্র বড়োরা চা পেতেন বছরের অন্যদিন গুলোতে ! কিন্তু, এই বিশেষ দিনে বড়োদের সঙ্গে ছোটরাও একসাথে নতুন পেয়ালাতে খেতে পারবে ! তার যে ছোটবেলায় কি আনন্দ বলে বোঝাতে পারবো না ! মনে হতো সেইদিন হঠাৎ করে বড়ো হয়ে গেছি ! সবার সঙ্গে একসারিতে আমি আছি ! আর, তার সঙ্গে মহালয়া শুনতে-শুনতে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে মুঠো করে স্নাক্স খাওয়া ! সেটাও কিন্তু আমার কাছে স্পেশাল ! ভোর পাঁচটায় মহালয়া শেষ হয়ে গেলে বন্ধুরা মিলে খেলতে যেতাম বিল্ডিঙের পেছনে একটা ছোট্ট সবুজ মাঠে আমাদের সিনথেটিক ফুটবল দিয়ে ! এই সিনথেটিক ফুটবলগুলো ছিয়াশির ওয়ার্ল্ডকাপ ফুটবলের পর খুব উঠেছিল ! কারণ, এগুলোতে বেশ সুইং করে শট মারা যেত ! দেখতে যেমন মজা ছিল, তেমনি খেলতেও ! মহালয়ার দিন থেকে একটু-একটু করে পারা মাইক ও আলো দিয়ে সেজে উঠতো ! তার সঙ্গে বহু খাবারের স্টলগুলো ফুটপাথের ওপর তাদের ভীত গেথে কাঠামো তৈরী করতে থাকতো ! 

পঞ্চমীর রাত থেকে যেন উত্তেজনায় ঘুম আসতো না ! পরের দিন হলো – ষষ্ঠী ! ঠিক ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ মাইকে শোনা যেত মহালয়ার অনুষ্ঠান আবার ! আর, তার কিছুক্ষনের মধ্যে ঢাকিরা ঢাক বাজিয়ে গণেশ আর কলাবৌকে নিয়ে স্নান করাতে নিয়ে যেত ! অফিসিয়ালি, পুজো শুরু !

আমরা তো ছোট ছিলাম ! তাই আমরা বিল্ডিঙের চারপাশেই ঘোরাফেরা করতাম ! ক্লাস এইট-এর পর থেকে আমরা বন্ধুরা মিলে অন্য পাড়ায় ঠাকুর দেখতে যেতাম ! তার আগে অবশ্য সকাল-সকাল ব্রেকফাস্ট করে অষ্টমী বাদে বাকি সব কদিন স্নান করে বেরিয়ে যেতাম – ঘরে ঢুকতাম দুপুরে খেতে ! আবার, খাওয়া হয়ে গেলে ঘন্টাখানেক রেস্ট নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়তাম ! এ-প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে – ছোটবেলায় দুবেলা নতুন করে জামা-কাপড় পড়া থাকতো ! তার সঙ্গে বাইরে মাইকে পুজোর মন্ত্র, ঢাকের শব্দ বা হিন্দি বা বাংলা ছবির গান শুনে ছুটির মাত্রাটাকে পুরোদস্তুর বাড়িয়ে তুলতো ! আর, সারা সকাল বা বিকেল বা সন্ধ্যে বেলায় ক্যাপ আর বন্দুকের বাহার দেখা যেত বন্ধুদের মধ্যে ! সবাই আমরা তখন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্র হয়ে “আবার যক্ষের ধন” খুঁজতে বেড়িয়েছি ! আর, শত্রুপক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যাপ ফাটিয়ে যুদ্ধ ! তারসঙ্গে, এদিক থেকে অন্য দিকে পালিয়ে গিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষা করা ! কখনো বা অরণ্যদেব, আবার কখনো জাদুকর ম্যানড্রেক, ও কখনো টিনটিনের রোমহর্ষক এডভেঞ্চার-এ যোগ দিয়ে ক্যাপ-এর যুদ্ধে মেতে উঠতাম ! আর, বড়ো দাদা বা দিদিরা পারায় রাখা পাথরের বসার জায়গায় বসে খেয়ে-দেয়ে আড্ডা মেরে সময় কাটাতো ! আমরাও, যখন বড়ো হয়েছিলাম – আমরাও তাই করেছি !

আরো একটা বিশেষ জিনিস ছিল ! ছোটবেলায় গোটা পুজোয় আমার হাত খরচ জুটতো হয়তো পাঁচ টাকা ! আর, পরের দিকে দশ টাকা ! আর সেই টাকায় আমায় দেখে কে ! আমি তো রাজা ! প্রথম দুদিন বিভিন্ন ছোট ষ্টল থেকে গাঠিভাজা, ঘুঘনি, ফুচকা, আইস-ক্রিম আর কোল্ড-ড্রিঙ্কস – কোনো কিছুই বাদ যেত না ! আর, তার থেকে বড়ো কিছু হলে বাড়িতে বায়না ! সেগুলো বাড়ির একাউন্ট দিয়ে হতো ! আর, এছাড়াও কিছু দরকার হলে – ঘরে গিয়ে চুপচাপ পায়চারি করতাম ! বাবা, খুব বেশি পুজোর সময়ে বাইরে বেরোতেন না ! কোনো নতুন পূজাবার্ষিকী নিয়ে পড়তে ব্যাস্ত থাকতেন ! কাজেই আমার পায়চারি দেখে মুচকি হেসে কত বললেই – আমি বলে দিতাম কি খাবার কিনতে চাই – আর, তার দাম কত ! বাবা, যদি একবার ব্যাগটা কাঠের আলমারি থেকে আনতে বলতেন, তাহলে তো মিশন সাকসেসফুল !

তবে অষ্টমীতে আমাদের বাড়িতে লুচি আর ভীষণ সুস্বাদু নিরামিষ রান্না সকালে হতো ! সকালে মা প্যান্ডেলে অঞ্জলি দিয়ে এসে রান্না করতেন ! মায়ের হাথের লুচি এতটাই ভালো ছিল যে আমার আর আমার দিদির বন্ধুরা এসেও খেয়ে যেত ! ময়দার সাদা ফুলকো লুচি, টকটকে লাল কষা আলুর দম, নতুন ফুলকপির ঝাল, বেগুন ভাজা, ছোলার ডাল নারকেলের কুচি দিয়ে, প্লাষ্টিক চাটনি আর সিমাইয়ের পায়েস !

রাতে অবশ্য ষ্টল থেকে কেনা চিকেন বা মটন বিরিয়ানির প্যাকেট বা অন্য কিছু ভালো খাবার !

অষ্টমীর সকালে যতই মজাই করি না কেন সন্ধে গড়ানোর সঙ্গে-সঙ্গে মনের মধ্যে একটু কষ্ট জুড়তে থাকতো ! অর্থাৎ, আর দুদিন পর পুজো শেষ ! এই বিগত এক বছরের সব পরিকল্পনা, আনন্দ আর কিছুক্ষনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে ! তবে, দশমিতেও কিন্তু আমরা খুব মজা করতাম ! কারণ, ঐদিন আমাদের পাড়ায় ধুনুচি-নাঁচ হতো ! সেই দেখার জন্য রাত দশটা অবদি লোকে অপেক্ষা করতো ! বাড়ির বড়োরা তখনও কিছু বলতো না ! হয়তো আমরা ছোটদের মতো তাদেরও মনে শেষ হওয়ার বিষাদ থাকতো !

একাদশীর দিন আমাদের ভাসান হতো ! আর, আমাদের বিল্ডিং-এর ভাসানের সব থেকে বড়ো আকর্ষণীয় বিষয় হলো – সব মিলিয়ে প্রায় সাতশো ছাপ্পান্নটা ফ্ল্যাটের অধিকাংশ লোকজন ঠাকুরের লরির সঙ্গে কিছুটা দূর পর্যন্ত হেঠে প্রসেশনের সাথে যেতেন ! লোকের এই কদিনের আনন্দটা যতটা সম্ভব আঁকড়ে ধরে রাখা যায় ! আমরা সবাই ফিরে এলে – বিজয়া দশমীর প্রণাম করতে পাড়ায় প্রত্যেক বাড়িতে (যাদের সঙ্গে আমাদের চেনাজানা আছে বা আমার বন্ধু) গিয়ে প্রণাম করা – কোলাকুলি করা ! আর সেই কাকিমা, বা জেঠিমার হাথে তৈরী ঘুঘনি, নিমকি বা নারকেল নাড়ু খেয়ে বাড়ি ফেরা !

এইসব আজও মনে পরে যত দূরেই থাকিনা কেন ! আর, আজীবন মনেও থাকবে !

পঞ্চম (শেষ) পর্ব – খ্রীষ্টমাস :
কলকাতায় বরাবরই খ্রীষ্টমাস ভীষণ পরিচিত ছবি ! তার, ঐতিহাসিক কারণও আছে ! ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার রাজধানী হওয়ার সুবাদে কলকাতায় বরাবরই ইউরোপিয়ান সভ্যতার একটা প্রভাব ছিল ! আর, যেহেতু একটি বড়ো সংখ্যক ব্রিটিশ নাগরিক এককালে এখানে থাকতেন, তাই এই শহরে পঁচিশে ডিসেম্বর ও ইংরেজি নতুন বছরের স্বাগত যে জমজমাট হবে – তাতে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় !

তাই ছোটবেলার বিশেষ এক ডিসেম্বরের কথা এই মুহূর্তে আমার মনে আসছে ! সাধারণত, বাবা নিউ-মার্কেটর নামকরা এক দোকান (যা পুরোনোদিনে হগ-মার্কেট নামে জানা যেত) থেকে একটা অত্যন্ত ভালো কেক ও কিছু প্যাস্ট্রি নিয়ে এসেছেন !  আমি বাইরে খেলতে গেছিলাম ! ঘরে ঢুকতেই এত্ত মিষ্টি একটা গন্ধে সারা ঘর ভোরে গেছে ! মা জানিয়ে দিলেন বিকেলে চা-এর সাথে ওই কেক আর পেস্ট্রির আয়োজন প্লেটে নামবে !

আমি তো এমনি খেতে ভীষণ ভালোবাসি ! তার ওপরে যদি ওতো সুস্বাদু কিছু খাবার অপেক্ষা করে – তাহলে যে কত কষ্ট ! তা মনে হয় বেশি বলার অপেক্ষা রাখে না ! পাড়ায় মাইক লাগিয়ে টুর্নামেন্ট হচ্ছে ফুটবলের ! দুপুরে লাঞ্চ করার পর বাবা জানালেন যে দুপুরে আমরা কাছেই ঘুরতে বেরোবো ! কাছেই ঝিলমিল বলে ছোটদের একটা মজাদার পার্ক আছে ! সেখানে আবার টয়-ট্রেনও আছে !

তাড়াহুড়ো করে সবাই মিলে তৈরী হয়ে চলে গেলাম ! সেখানে টিকেট কেটে ঢুকে ঘুরে-ঘুরে চারপাশটা দেখতে থাকলাম ! বেশ খানিক্ষন ঘুরে একটু গাছের ছায়া দেখে ঘাসের ওপর একটা চাদর পেতে সবাই বসলাম ! মা ফ্লাস্কে করে গরম চা আর প্লাস্টিকের কয়েকটা কাপ এনেছিলেন ! আর, তার সঙ্গে বাবার আনা প্যাস্ট্রি ! সত্যি কথা বলতে কি – খাবারের গুন অনেক বেড়ে যায় সঠিক জায়গায় সঠিকভাবে দিলে ! এরপরে, আরো কিছু রাইড চড়ে সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি ফিরলাম ! পাছে মাকে আর রান্না না করতে হয়, তাই স্থানীয় ধাবা থেকে আনা রুমালি রুটি আর চিকেন তড়কা দিয়ে ডিনারটা কিন্তু আরো মনোরম করে দিলো !

তবে এখানেই শেষ নয় ! কারণ, ইংরাজীর নতুন বছর ও আসবে ! আর, তার আগে প্রতিটা দিনই ছোট খ্রীষ্টমাস পালন করা হলো ওই কেক দিয়ে ! সঙ্গে সবার জন্য নেসক্যাফে ! শীতের ঠান্ডায় শরীর গরম করার এর থেকে ভালো বাঙালি উপায় হয়তো আমাদের কারোরই জানা ছিল না !

একত্রিশে ডিসেম্বর কিন্তু আবার সারপ্রাইজ রইলো ! সন্ধে বেলায় হঠাৎ গাড়ি করে পার্ক-স্ট্রিটের ওয়ালড্রপ হোটেলের সামনে হাজির ! এই সময়ে পার্কস্ট্রিটের মাহাত্মটাই আলাদা ! সারা পার্কস্ট্রিটটা আলোয় ঝলমল করছে ! লোকজন সান্তাক্লজ-এর লাল রঙের জোহর কোটটা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ! মুখে কৃত্তিম সাদারঙের দাড়ি ! সেখানে কিছুক্ষন ঘোরাফেরা করে হোটেলে ঢুকে চিলি-চিকেন, মিক্সড-ফ্রাইড রাইস, সূপ আর কোল্ডড্রিঙ্কস দিয়ে খেয়ে ও শেষে ফরচুন কুকিজ নিয়ে মজা করতে-করতে বাড়িতে ফিরলাম ! আর তার কিছুক্ষনের মধ্যে নতুন ইংরেজি বছর গোনার কাউন্টডাউন শুরু ! আর, তারপর সবাই মিলে একসাথে আনন্দে ও চিৎকার করে – “হ্যাপি নিউ ইয়ার” বলে নতুন বছরকে স্বাগত করার অভিজ্ঞতা কিন্তু আজো ভুলবো না ! সেই সঙ্গে নানারঙের হাউই আকাশে উঠে রং-বেরঙের প্রতিকৃতি করা, ও সব শেষে নতুন বছরের সংখ্যা আকাশে ভেসে ওঠা !

তাই আজও ওই দিনটা আমার মনে বেশ দাগ কেটে আছে !

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ : সমস্ত ছবি আমার নিজের তোলা – এই ছবির সাথে গল্পের চরিত্রের কোনো মিল নেই ! নেহাৎ প্রচ্ছদের কারণে প্রতীকী হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে !
বিশেষ ঘোষণা :
  • আমার এই গল্পের মূল কাহিনীর সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই ! যদি, কোনো কারণে তা হয়েও থাকে, নিতান্তই কাকতালীয় !
আমার গল্প কেমন লাগলো তা এখানে একটা ছোট্ট-কমেন্টস দিয়ে জানালে খুব ভালো লাগবে !

আশা করি আপনারা সবাই ভালো থাকবেন ও সুস্থ থাকবেন !

@কপিরাইট – সাত্যকি দে
Subscribe বোতাম এ ক্লিক করুন আপনার ইমেইল দিয়ে, ও আরো অনেক ছবির সাথে ঘুরতে যাওয়ার গল্প পড়ুন !