প্রথম পর্ব :
সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝির দিকে ! তখন কলকাতায় অন্যতম অভ্যাস ছিল লোড-শেডিং বা পাওয়ার কাট, যা আজকের দিনে অধিকাংশ ছোটরা হয়তো জানেও না বা কোনোদিন দেখেনি ! প্রায়, প্রতিদিনই ঘন্টাখানেক বা দুয়েক এর জন্য বাড়িতে বিদ্যুৎ থাকতো না ! তাই, সেই সময়কে ঘিরে প্রায় প্রত্যেকেই তাদের জীবনকে খানিকটা সাজিয়ে নিয়েছিল ! বলা যায়, দৈনিক অভ্যেস ! সেই সময়ে ছোট-বড়ো প্রায় প্রত্যেকেই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হতো – প্রচন্ড গরমের হাত থেকে খানিকটা স্বস্তি পেতে ! যখন, রাতে বাড়ির পাশে থাকা বড়ো-বড়ো বট বা অশত্থ গাছগুলো থেকে ঠান্ডা হাওয়া বেরোতো, তার যে তৃপ্তি – তা আজকের দিনের এসির ঠান্ডাকেও হার মানিয়ে রেখে দেবে ! আমাদের পাড়াটা আগেই বলেছি বেশ পুরোনো ছিল ! যদিও সেই সময়ে এতো পরিকল্পিত, ও, এতো বড়ো এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স কলকাতায় আর একটিও ছিল না ! প্রায়, সাড়ে সাতশো পরিবার থাকতো ! যখন বিদ্যুৎ থাকতো না, সেই সময়ে – আমাদের বিল্ডিং ও তার চারপাশের সমবয়সী বন্ধুরা একতলায় পাঁচিলের ওপরে বসে গল্প করতাম ! কখনো বা পাড়ার কোনো দাদা, কাকু, বৌদি বা কাকিমাদের থেকে তাদের নানা অভিজ্ঞতার কথা বা গল্পও শুনতাম ! তাই, ওই মুহূর্তটা ছিল আমাদের জন্য বাড়তি ছুটির পাওনা ! কেবলমাত্র, পরীক্ষার সময়ে এর ব্যাতিক্রম হতো ! তখন, চোখ দিয়ে জল পড়লেও, মোমবাতি কিংবা হারিকেনের আলোয় গরমে ঘেমে স্নান করে হলেও পড়তে হতো ! তবে, আমাদের আজকের গল্প হলো সেই সাধারণ দিনগুলোতে, যখন আমরা বাইরে আড্ডা মারতে বেরোতাম !
দ্বিতীয় পর্ব :
তখন সবে “মে”-মাস ছেড়ে “জুন”-মাস পড়েছে ! প্রচন্ড গরমে প্রায় সবার অবস্থা খুব খারাপ ! যদিও, তাতে আমাদের বিকেল বেলায় খেলতে যাওয়ার কোনো বাধা ছিল না ! সেইরকম একদিন, বিকেল বেলায় আমরা “সিনথেটিক”- ফুটবল দিয়ে বিল্ডিঙের টুর্নামেন্ট খেলছিলাম ! এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো – যে, সেই সময়ে একধরণের ফুটবল ছোটদের জন্য বেরিয়েছিল, যেগুলো ওজনে হালকা, সিনথেটিক কোনো পদার্থ দিয়ে ওগুলো তৈরী হতো ! এই বলগুলোর বিশেষত্ব ছিল যে, এগুলো একটু কায়দা করে মারলে ভীষণ ভালো সুইং করতো ! ঠিক যেমন মক্সিকো ৮৬ ওয়ার্ল্ডকাপ ফুটবলে আমরা দেখেছিলাম ! কাজেই, ভালোভাবে গোল করতে পারলে, ওপরে থাকা চারপাশের বিল্ডিঙের বড়ো কাকু, কাকিমা বা সিনিয়র কোনো দাদারা দেখে বড়ো বাহবা দিতো ! সেটা, সেই সময়ে আমাদের কাছে ছিল – বিশাল প্রেস্টিজের ব্যাপার !

তার থেকেও বড়ো কথা, সেই সময়ে আমরা প্রায় সকলেই “দিয়েগো মারাদোনা”-এর ম্যাজিক-এ বড়োই আক্রান্ত ! সুতরাং, দুই বিল্ডিঙের মাঝের ছোট্ট-মাঠটা ছিল আমাদের কাছে ওয়ার্ল্ডকাপ স্টেডিয়াম ! আর, ওপরের কাকু, কাকিমারা হচ্ছেন – সেই স্টেডিয়ামের দর্শক ! তাই, মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা সবার চলতো ! জিততেই হবে, নাহলে আর্জেন্টিনার নামের মর্যাদা থাকবে না ! সত্যি কথা বলতে কি – আমরা যে যেমন পসিশন-এ খেলতাম, সেই পসিশনের – আর্জেন্টিনা টিমের খেলোয়াড়দের নামে – আমরা নিজেদেরকে ডাকতাম ! আজকের দিনে হয়তো “আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স” ও “অগমেন্টেড রিয়েলিটিতে” দেখাটা খুব সহজেই সম্ভব ! এখানে এও বলে রাখি – অগমেন্টেড রিয়ালিটি হলো এমন একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম যার সাহায্যে আপনি নিজেকে অন্য দুনিয়ায় দেখতে পাবেন ! ধরে নিন, আপনি চোখে একটি চশমা পড়েছেন ! আপনি কলকাতায় থেকে প্যারিসের কোনো শহর দেখতে চাইছেন ! এই প্রোগ্রামের ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স এর সাহায্যে আপনি ওই চশমায় থাকা ছোট্ট স্ক্রিন এর মধ্যে দিয়ে প্যারিস শহরটাকে দেখতে পারবেন ! আপনার, মনে হবে আপনি কলকাতায় নন, প্যারিসের কোনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন ! এবং, আপনি যেভাবে মাথা ঘোরাবেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ঠিক সেইভাবে প্যারিসের ওই রাস্তার চারপাশের সব দৃশ্য আপনার চশমার ছোট পর্দায় তুলে ধরবে ! এবং, আপনার কিছুক্ষন পর মনেই হবে না যে আপনি কলকাতায় আছেন, প্যারিসে নন ! কিন্তু, তখন অবশ্য সেসব “অগমেন্টেড রিয়ালিটি” আমাদের চোখেই থাকতো ! আমরা যেন দেখতে পেতাম, সেই দলের হয়েই বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামের মাঠে খেলছি !

এইরকম উত্তেজনা ভরা ম্যাচে টস জিতে আমরা ভালো দিকটা নিয়ে নিয়েছি, যেখান দিয়ে এটাক করতে সুবিধা হয় ! এ-প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমাদের দিকে একটু বড়ো ঘাস থাকায় উল্টোদিক দিয়ে বিপক্ষ দলকে অনেক বেশি বলকে তুলে মেরে গোল করার চেষ্টা করতে হবে ! যেহেতু, গোলপোস্ট আমাদের কোমর পর্যন্ত, তাই তাদের গোল করতে অনেক বেশি খাটতে হবে ! অনেক জোরে বলটাকে মারতে হবে ! কিন্তু, আমাদের সেটা করতে হবে না ! এইরকম একটা উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ সবে শুরু হয়েছে ! আমাদের দলের ক্যাপ্টেন হলাম আমি ! আর অন্য দলের ক্যাপ্টেন হলো – বুন ! আমাদের দলে আমার পার্টনার পটাই, আমার সঙ্গে ফরওয়ার্ড খেলবে ! সেন্টার ফরওয়ার্ড  ও দুই দিকে ডিফেন্ডার খেলবে যথাক্রমে – টুঙ্কা, রিশ আর মিঠু ! গোলে আছে আমাদের থেকে বয়সে ছোট সান ! উল্টোদিকে বুনের দলে – ওর সাথে ফরওয়ার্ড খেলবে – বিলু ! আর, বাকি তিন পসিশন এ – বাবু, ল্যাটা আর নব ! আর ওদের গোলে রয়েছে আমাদের থেকে একটু বড়ো বাবু-দা !

তৃতীয় পর্ব :
ফুটবল খেলোয়াড় হিসাবে আমার আর পটকার বেশ ভালো নাম ছিল বোঝাপড়ার জন্য ! আমি বাঁ-দিক দিয়ে উঠতাম, আর ও ডান-দিক দিয়ে ! আমাদের চোখে-চোখে এমন ইশারা চলতো যে বন্ধুদের বাকিরা ঠিক বুঝতেই পারতো না যে – কে কোনদিকে বলটা ঠেলবে ! তাই, শুরুর দশ-মিনিটের মধ্যে সেই বোঝাপড়ার প্রথম সফল সুযোগ পেলাম ! আমার একটা ছোট্ট পাশে পটকা বল নিয়ে গোলকীপারকে হালকা বাঁ-দিকে টেনে বলটাকে একটু ড্রিবল করে আরেক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোল ! সে এক দেখার মতো ছোট্ট পাশে গোল করা ! ঠিক যেভাবে মারাদোনা আর বুরুচাগাকে আমরা খেলতে দেখেছিলাম টিভিতে ! তার থেকেও যেটা বড়ো হলো – ওপরে পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কিছু কাকু আর দাদারা চিৎকার করে বলে উঠলো – “ব্রিলিয়ান্ট”, “অসাধারণ” ! এই ঘটনায় আমরা যেমন চার্জড হয়ে গেলাম, ততটাই বুনের দল আরো মরিয়া হয়ে উঠলো – পাড়ার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদেরকে তাদের স্কিল দেখানোর ! আরো একটা কথা বলে রাখার দরকার যে, আমাদের গোলের ঠিক পেছনেই রয়েছে বিল্ডিঙে ঢোকার সিমেন্ট করা রাস্তা ! তাই, বয়স্ক – কেও এলে আমাদেরকে সাময়িক একটু থামতে হতো ! কিন্তু, আমাদের শুরুতেই সাফল্য হওয়াতে সেইসব অনেকেরই মাথার থেকে সাময়িকভাবে বেরিয়ে গেলো !

নেক্সট গেম শুরু হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে পুরো দস্তুর এটাক বুনের টীম করতে শুরু করলো ! একের পর এক আক্রমণ ! বাধ্য হয়ে আমাদের গোটা টিমকে নিচে নেমে পুরোদস্তুর ডিফেন্সিভ হয়ে খেলতে হতে হলো ! তার মধ্যে, ওদের দলের প্লেয়াররা একের পর এক হাঠুর থেকে একটু ওপরে, অথচ, কোমরের থেকে নিচে রেখে লং-রেঞ্জ-এ শট মারতে থাকলো ! সান ছাড়াও, কখনো আমি, কখনো পটাই বা আমার বাকি দলের লোকেরা প্রায় শরীরটাকে বলের সামনে ছুড়ে দিয়ে আটকাতে থাকলাম ! এমন সময় আচমকা বিলু সাইড দিয়ে এসে আলতো করে একটা কমজোরি চিপ শট নিলো ! এই শটটা কিন্তু একদমই জোর ছিল না ! কিন্তু, যে প্রচন্ড গতিতে ও ছুটে এসেছিলো, তাতে আমরা প্রায় প্রত্যেকে বলের গতি ভুল বুঝে ঝাঁপালেও বলটা অনেক কম গতিতে বিনা বাধায় একটা ড্রপ করে গোলের ভেতরে ঢুকে গিয়ে সিমেন্টের রাস্তায় হাটতে থাকা হাবুলদার বাবার পায়ে গিয়ে লেগে থেমে গেলো ! বলটাতে সামান্য কাদা থাকাতে ওনার অপেক্ষাকৃত সাদা পায়জামাতে বলের একটা ছোট্ট ছাপ পরে গেলো !

চতুর্থ পর্ব :
এ যেন ভুল ব্যালটে ভোট পরে গিয়ে ঝামেলা শুরু হওয়া ! হাবুলদার বাবার চিৎকার – তার সঙ্গে উনি, আমাদের প্রায় প্রত্যেকের অন্নপ্রাশনের, জন্মদিনের ও বাকিদিন গুলোর সব দুর্দশাময় কাহিনীগুলোর থেকেও খারাপদিনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন ! এ যেন কয়েক মিনিটের ক্র্যাশ কোর্স – বাজে অভিজ্ঞতার ! আমরা সেই সময়ে খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে, আর খানিকটা ভয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেছি ততক্ষনে ! একটু পরে ওনার আক্রমণ আর আমাদের খেলা নিয়ে নয় – অন্য কিছু নিয়ে শুরু হয়ে গেছে ! এর মধ্যে আমরা প্রায় সবাই এক জোট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি ! হঠাৎ শুনলাম পেছন থেকে কেও যেন – “সসসসসস…” করলো ! বাস, গোটা ঘটনাটায় যেন আগুনে ঘি পড়ার মতো হয়ে গেলো ! উনি চিৎকার করে বলতে শুরু করে দিলেন – “হতচ্ছাড়া, কে করছিস বল ? আমার সুগারের রোগ আছে ! তাই, তোরা এইরকম আওয়াজ করছিস, যাতে, আমি দাঁড়িয়ে না প্রতিবাদ করতে পারি !”

ইতিমধ্যে, ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকজন কাকু বলতে শুরু করেছেন – “আরে কাবুলদা, বাচ্ছাগুলো কোথায় খেলতে যাবে ? সব মাঠগুলোতে তো বিল্ডিং উঠে যাচ্ছে ! একটু খেলতে দিন ! কোনো খারাপ কিছু তো করছে না !” এই শুনে উনি আরো জলে উঠলেন !

বলে উঠলেন – “এই আপনাদের আস্কারায় এইসব বান্দরগুলো আরো বেড়ে চলেছে !”

এই শুনে বিলু বলে উঠলো – “কাকু, আমরা কি করেছি ! শুধু খেলছিলাম তো ! বাঁদর কেন বলছো ?”

কাকু বলে উঠলেন – “তোরা সবকটা এক-একটা আস্ত বাঁদর ! লোকের যাতায়াতের রাস্তার থেকে কমপক্ষে দু-মাইল দূরে খেলগে ! পড়াশোনা নেই ? সারাক্ষন, বাইরে খেলে চলেছিস ! কি সকালে, কি দুপুরে, কি সন্ধে বেলায় অন্ধকার হয়ে গেলে ! আর, বলিহারি তোদের মা-বাবার – সব সময় ছেড়ে দেয় !”

সত্যি কথা বলতে কি – এই কথাগুলো শুনে সবার খুব রাগ হলো ! কিন্তু, যেহেতু, বাকি কাকু আর দাদারা নিচে নেমে এসেছিলো ! তাই, ওরাই কাকুকে নিয়ে সরিয়ে চলে গেলো ! আমাদের পুরো মুডটাই অফ হয়ে গেলো !

এর মধ্যে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে ! চিৎকার চেচামেচিতে বাড়ির সবাই বেরিয়ে এসেছিলো ! তাই, এবার প্রায় সবারই বাবা-মা আমাদেরকে বাড়িতে ঢুকে যেতে পড়লো একটু আগেই ! তাতে, মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো !

পঞ্চম পর্ব :
বাড়িতে ঢুকেই মা বললো – “আর খেলতে হবে না ! কালকে স্কুলে অনেক পড়া আছে ! তার ওপর আজকাল ভীষণ কারেন্ট চলে যায় ! তখন, আবার এমনি বেরিয়ে যাবে ! তার আগে যতটা সম্ভব – পড়াগুলো মুখস্থ করে ফেল ! আমি এক-এক করে ধরবো !”

আমিও ইতিহাস বই নিয়ে বসে গেলাম ! কারণ, তার পরেরদিন স্কুলের সব থেকে ভয়ঙ্কর “কাঞ্চনবাবু”-র ক্লাস আছে ! ওনার ক্লাসে পড়া না পারলে বড়ো কঠিন শাস্তি ! ওই শাস্তি যে দেখেছে, সে ভুল করেও না পড়া করে যাবে না ! আমি পড়তে শুরু করলাম সম্রাট অশোকের রাজত্বকাল ! পড়াটা প্রায় আয়ত্ত করে ফেলেছি ! এর মধ্যে মা এসে ওটা লিখতে বলে দিলো ! আমার আবার খাতায় একবার লিখে মাকে দিয়ে দেখিয়ে নিলে, পড়াটা মনে রাখতে খুব সুবিধা হতো ! এর মধ্যে দেখলাম, মা চিমনিটা জ্বালিয়ে দিয়ে খুব কম আঁচে রেখে দিলো ! যদি কারেন্ট চলে যায়, তাহলে আর অন্ধকারে হাতড়ে দেশলাই বার করে চিমনি ধরাতে হবে না ! শুধু আঁচটা বাড়িয়ে দিলেই হবে !

তিনটে প্যারাগ্রাফ লেখা হয়েছে ! আর একটা প্যারাগ্রাফ বাকি, এর মধ্যে ঝপাং করে কারেন্ট চলে গেলো ! তাতে আমার অবশ্য খুব একটা অসুবিধা হলো না ! আমি চিমনির আঁচটা বাড়িয়ে দিয়ে শেষ প্যারাগ্রাফটা লিখতে শুরু করে দিলাম ! প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যে লেখাটা লিখে আমি রিভিশন করতে থাকলাম চটপট করে ! যত তাড়াতাড়ি করে মাকে দিয়ে দেখিয়ে নিতে পারবো, তত তাড়াতাড়ি আমি লোডশেডিং ব্রেইক নিয়ে বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে পারবো ! এমনিতেও সেইদিন তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকতে হয়েছিল ! তাই, যেন আরো বেশি ছটফট করছিলাম !

সবে মা আমার খাতা নিয়ে রিভিউ করতে বসেছে ! এর মধ্যে বাইরে থেকে চিৎকার শুনতে পারলাম ! কে যেন তারস্বরে চিৎকার করছে – “চোর – চোর ! চুরি করে নিয়ে গেলো ! ধরো – ধরো ! কেও একটু ধরো গো !”

ষষ্ঠ পর্ব :
বিল্ডিঙের প্রায় সবাই অবাক হয়ে চিৎকার শুনে বেরিয়ে এসেছে ! আমাদের বাড়ি থেকেও বাবা, মা আর সঙ্গে আমিও বেরিয়ে গেছি ! মাথায় আসছিলো না – ভর সন্ধ্যায় কার এতো সাহস, যে বিল্ডিঙের ভেতর থেকে কারোর কিছু চুরি করে নিয়ে যাবে ! যতই অন্ধকার থাকুক না কেন ! ধরা পড়লে যা খাবে – সেই ভয়ে চট করে আমাদের বিল্ডিঙে ওরকম কোনো ঘটনা ঘটে না !

তার থেকেও বড়ো প্রশ্ন – “কার চুরি হয়েছে ? আর, কি বা চুরি করে চোর পালালো ?”

গিয়ে দেখি – হাবুলদার বাবা চিৎকার করছে ! আর, যারা অলরেডি আমাদের আগে পৌঁছে গেছে – তারা দেখি মুচকি-মুচকি হাসছেন !

বাবা জিজ্ঞাসা করলেন – “কাবুলদা – কি চুরি হয়েছে ?”

উনি বলে উঠলেন – “আর বলবেন না ! এই সবে শান্তির দোকান থেকে টাটকা মিষ্টি-দই এর একটা পাঁচশো গ্রামের ভাঁড় নিয়ে ফিরছিলাম ! সবে আমাদের বিল্ডিঙে ঢুকেছি ! চোর আমার হাত থেকে ভাঁড়টা কেড়ে নিয়ে পালালো ! কি বলবেন বলুন !”

বাবা জিজ্ঞাসা করলেন – “আর, আপনার পয়সার ব্যাগ ?”

কাকু বললেন – “না ! সেসব তো কিছু নিলে না ! শুধু, আমায় ধাক্কা মেরে বললো – মিষ্টিটা আপনার খাবার দরকার নেই ! সুগারের রুগীদের উচ্ছে খাওয়া উচিত !”

এর মধ্যে কাবুল দাও দেখি কখন নিচ থেকে নেমে এসেছে ! বাবার দইয়ের কথা শুনে বেশ খানিকটা নালিশের সুরেই প্রশ্ন করলো – “বাবা ! তোমায় না ডাক্তার মিষ্টি খেতে বারণ করেছিল ! মা – ঘুরতে গেছে বলে অমনি লুকিয়ে লুকিয়ে কিনে এনেছো ?”

এই কথা শুনে – কাকু বলে উঠলেন – “ওহ ! তোর জন্যই এনেছিলাম ! মায়ের নেওটা একটা ! তবে, তোকে দেওয়ার আগে দেখে নিতে হবে না যে দইটা ঠিক আছে কিনা ! কখন এনে রেখেছে ! তাই, আগে আমি একটু চেখে দেখে বাকিটুকু তোকেই দিতাম ! মনিটর এসেছে ক্লাসের ! ওসব তোর স্কুলে দেখাবি ! ঘরে নয় !” – এই কথা শুনে কাবুলদাও চুপ মেরে গেলো !

কাকু আরও বললেন – “এতো আর রোজ আনছি না ! শুধু আজকের জন্য ! শান্তির দোকানে গেছিলাম ! দইটা দেখে মনে হলো আমারও তো একটা কর্তব্য আছে ! আমাদের পাড়ায় এতো নাম ! কিন্তু, এখনো কি সেই কোয়ালিটি আছে ! সেটা দেখতে হবে না ? আর, যখন ও জানতে চাইলো যে আমরা ওদের নতুন গুড়ের মিষ্টি দইটা খেয়েছি কিনা !”

তারপর, আমার বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন – “আমারও তো একটা দায়িত্ব তো থাকে একই পাড়ায় থাকার জন্য ! মানুষ হয়ে আরেকটা মানুষের সাহায্য করবো না ? এটা হয় বলুন ?”

বাবা শুনে – একটু মুচকি হেসে কিন্তু গম্ভীর গলায় বললেন – “ও তাহলে খুব ভালো চোর বলতে হবে ! আপনার খেয়াল রেখেই বলেছে ! আমার মনে হয়না আপনি আর ওই দই পাবেন ! বরং, সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে যান কাবুলের সাথে !”

“কাবুল, বাবাকে অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যাও সাবধানে ! দেখো, উনি যেন পরে না যান ! এমনি খালি হাথে বাড়ি ফিরছেন জিনিস কিনেও ! তার ওপর পরে গিয়ে কিছু হলে আর আফসোসের শেষ থাকবে না !” – একথা এবারে বাবা কাবুলদাকে বললেন !

কাকু বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন – “বাজার থেকে টাটকা দইটা নিয়ে এলাম ! ভাবলাম, একটু তৃপ্তি করে ছেলেটাকে খাওয়াবো ! আর, নিজেও একটু চেখে দেখবো ! কপাল – সব ই আমার কপাল ! কি আর বলবো !”

যখন, সবাই বুঝলো যে আসল চোর নয়, নিশ্চই বিল্ডিঙের কোনো ছেলে-ছোকরার কাজ ! তখন, সবাই ঘরে ঢুকে গেলো ! আর, আমি মাকে বলে – বাইরে আমার বন্ধুদের খুঁজতে থাকলাম ! কিন্তু, কাউকেই যেন পাচ্ছি না !

হাতড়ে-হাতড়ে আমি চারতলায় উঠে দেখছি কিছু চেনা গলায় ফিসফিস আওয়াজ হচ্ছে ! সঙ্গে কিছু হাসির আওয়াজ ! খানিকটা কাছে যেতেই বিলুর গলা শুনতে পেলাম ! তারপর, আরেকটু কাছে যেতেই দেখি প্রায় সবাই মিলে ঝুকে পরে কিছু একটা করছে ! এগোতে-এগোতে যখন প্রায় একহাত দূরে দাঁড়িয়ে, তখন দেখি সবাই মিলে ভাগাভাগি করে কি একটা খাচ্ছে ! আমি যেতেই বিলু বললো – “এই খুব ভালো খেতে ! শান্তিদার দইয়ের কোনো জবাব নেই !”

আমি বললাম – “এই তোরা নিয়েছিস ?”

বিলু বললো – “না ! আমাদের হাথে কেও একটা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো অন্ধকারে ! বললো ! বিকেলে ভালো খেলার পুরস্কার ! চুপচাপ খেয়ে যা ! কোনো আওয়াজ করবি না ! তাই, আমরা খাচ্ছি !”

কথাটা শুনে আমি হয়তো খানিকটা আন্দাজ করতে পারলাম কে করেছে ! কিন্তু, আর বেশি কথা না বাড়িয়ে এক আঙ্গুল তুলে নিয়ে ভাঁড়ে একটু বুলিয়ে, মুখে পুড়ে দিলাম আর মনে-মনে ভাবলাম – “সত্যি ! শান্তিদার দইয়ের কোনো জবাব নেই !”`

বিশেষ ঘোষণা :
  • সমস্ত ছবি আমার নিজের তোলা – এই ছবির সাথে গল্পের চরিত্রের কোনো মিল নেই ! নেহাৎ প্রচ্ছদের কারণে প্রতীকী হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে !
আমার গল্প কেমন লাগলো তা এখানে একটা ছোট্ট-কমেন্টস দিয়ে জানালে খুব ভালো লাগবে !

আশা করি আপনারা সবাই ভালো থাকবেন ও সুস্থ থাকবেন !

@কপিরাইট – সাত্যকি দে
Subscribe বোতাম এ ক্লিক করুন আপনার ইমেইল দিয়ে, ও আরো অনেক ছবির সাথে ঘুরতে যাওয়ার গল্প পড়ুন !