প্রথম পর্ব :

ছোটবেলায় বিশ্বকর্মা পুজো আসা মানেই দ্বিগুন খুশির বার্তা ! প্রথমত, ওই পুজোতে ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে পাড়া-পড়শীর ওপর অভিযান করে নিজের যোগ্যতা প্রমানের চেষ্টা, ও সাথে জেতার এক অদ্ভুত আনন্দ ! দ্বিতীয়ত, বিশ্বকর্মা পুজো মানেই হলো বাঙালির সব থেকে বড়ো অনুষ্ঠান অর্থাৎ দূর্গা-পুজোরও অলিখিত ঘোষণা ! সাধারণত, বিশ্বকর্মা পুজোর এক মাস পরেই দূর্গা-পুজো হয় !

তার, সঙ্গে আছে আরো নানা ছোটোখাটো বিষয়ে আনন্দ ! এই যেমন, কে কোথা থেকে সুতোর মাঞ্জা কিনে আনবে বা পাড়ায় দেবে ! তখন লোকের হাথে এতো পয়সা তো ছিল না, আর আজকের মতো সস্তার চীনা-মাঞ্জাও পাওয়া যেত না ! সুতরাং, বাড়িতে বসে মাঞ্জা দেওয়ার অভিজ্ঞতাটাও কিন্তু কম রোমাঞ্চের নয় !

এছাড়া, থাকতো – আগের দিন রাতের বেলায় বুড়ি ঘর পোড়ানোর অভিযান ! কি মজাই না করেছি এইসব দেখে বা বন্ধুদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে ! সত্যি কথা বলতে কি – তখন আমাদের বয়সী ছোটরা সবাই বাইরেই বেশি থাকতে পছন্দ করত ! তখন, আজকের দিনের মতো না ছিল এতো ভিডিও-গেমস, না ছিল চব্বিশ-ঘন্টার টিভি ! তাই, আক্ষরিক অর্থে এইসব অনুষ্ঠান গুলোই ছিল জীবনের প্রথম ও প্রধান আনন্দের জায়গা !

দ্বিতীয় পর্ব :

তখন, সবে ক্লাস এইটে উঠেছি ! বিশ্বকর্মা পুজো সামনে আসছে ! সুতরাং, বন্ধুদের মধ্যে কিছু একটা চমক দিতে হবে ! তার সঙ্গে এও জানি পাড়ায় মানে আমাদের বিল্ডিঙের ছাদে মাঞ্জাও দেওয়া হবে ! পাড়ায় এক দাদা থাকতো আমাদের বিল্ডিঙের চার-তলায় ! ও আবার এইসব ব্যাপারে তখন আমাদের “গুরু” ! সত্যি কথা বলতে কি – ওই দাদা সারাজীবন ছোটদের সঙ্গে খেলাধুলো নিয়েই ব্যাস্ত রইলো ! কিন্তু, কখনো ছোটদের অসম্মান করতে দেখিনি ! সব সময় সেই সম্মানটা দিয়ে বন্ধুর মতো মিশতো ! তাই, আমরাও সেই সম্মানটা দিতাম ! কি ফুটবল, কি ক্রিকেট, কি ব্যাটমিন্টন – কোনো কিছুতেই তাকে হারানো যেত না ! বলা যেতে পারে অলিখিত কোচ ছিল আমাদের ! তার থেকেও যেটা বড়ো, সেটা হলো ওর এনার্জি ! আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলেও, ও হতো না ! আর, সেই দাদা যখন মাঞ্জা দিয়ে নিজের সুতো বানাবে, তার থেকে দূরে থাকাটাও তো সম্ভব নয় !

ঠিক হলো বিশ্বকর্মা-পুজোর আগের দিন দুপুরে মাঞ্জা তৈরী করে রাতে সবাই মিলে দেওয়া হবে সুতোতে ! আবার, আগেই বলেছি যে বন্ধুদের একটু চমকেও দিতে হবে ! তাই, মনে-মনে ঠিক করলাম আমাদের স্কুলের পেছনে এক বিহারি দোকানে এই সময়ে সুতো বিক্রি করতো ! আর, ওদের মাঞ্জার বেশ নাম-ডাকও ছিল ! স্কুলের কয়েকজন বন্ধুর মুখেই ওই দোকানের কথা প্রথম শুনেছিলাম ! তাই, অনেকটা কৌতূহলের বসে প্রথম দিন গিয়ে দেখে এলাম !

দোকানে ঢুকে তো পুরো তাক লেগে গেলো ! কত রকমের ঘুড়ি – পেট-কাটা, চাঁদিয়াল, মুখ-পোড়া ও আরও কত কি ! আর, তার সঙ্গে ততরকমের মাঞ্জা দেওয়া রং-বেরঙের সুতো ! গিয়ে তো মনে হতে লাগলো – সবই কিনে নিয়ে আসি ! কিন্তু, তখন তো টাকা নেই ! আর, এমনিও সব কিছু তো কিনতে পারবো না !

বাড়ি ফিরে অপেক্ষা করতে থাকলাম ! সন্ধে বেলায় বাবা বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে খবরের কাগজ নিয়ে পড়তে বসলেন ! এখুনি, কিছু বলা যাবে না ! মা রান্নাঘর থেকে জলখাবার বানিয়ে নিয়ে এসে বাবাকে দিলেন ! এরপর, বাবার পছন্দের চা বানিয়ে দিয়ে গেলেন ! বাবা অর্ধেকটা শেষ করার পর, আমি আস্তে-আস্তে উঠে বাবার কাছে গিয়ে বসলাম ! বাবা আমায় দেখে বললেন যে – “পিঠটা হালকা করে একটু টিপে দেতো !” আমিও দিতে শুরু করে দিলাম ! মিনিট দশ-পনেরোর পর বাবা মুচকি হেসে বললেন – “কত ?”

আমি সঙ্গে-সঙ্গে বলতে থাকলাম – “ওই যে স্কুলের সামনে, একটা নতুন দোকানে খুব ভালো মাঞ্জা বিক্রি হচ্ছে ! তাই, তুমি যদি দেড়-টাকা দাও ! “

বাবা বললেন – “ব্যাগটা নিয়ে আয় !”

আমি যেন আনন্দে আর নিজের হাসি চেপে রাখতে পারছি না ! দৌড়ে গিয়ে কাঠের আলমারির ওপর থেকে ব্যাগটা নিয়ে এসে দিতেই, সেখান থেকে বাবা “দেড়-টাকার” খুচরো আমার হাথে তুলে দিলেন !

পরের দিন সকালে স্কুলে পৌঁছে টিফিন পিরিয়ডের অপেক্ষা ! টিফিন পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে সেই দোকান থেকে নতুন ধরণের – “লোড-শেডিং” মাঞ্জা কিনে আনলাম ! এই মাঞ্জাটা অন্যগুলোর থেকে বেশ দামি, আর রংটাও একদম আলাদা ! প্রায়, রামধনুর রঙের মতো বিভিন্ন রং ছড়িয়ে রয়েছে সুতোটাতে ! অন্য মাঞ্জাগুলো সাধারণত এক রঙের হয় !

ব্যাস ! আমার কাছে এক নতুন অস্ত্র চলে এসেছে ঘুড়ি প্রতিযোগিতায় ! এইবার, আর কে লড়বে আমার সাথে ! সঙ্গে তো বিল্ডিঙে নিজেদের বানানো দাদার তৈরী স্পেশাল মাঞ্জা তো আছেই !

তৃতীয় পর্ব :

একথা বলতে বাধা নেই, এমনিতে আমার বাবা রাশভারী মানুষ হলেও, এমন অনেক জায়গায় বাবা আমাদেরকে উৎসাহিত করতেন, যা অনেক সময়ে আমাকে অবাক করে দিতো ! সেইরকম, এক ঘটনা হলো ঘুরিতে মাঞ্জা দেওয়ার ! চারতলার দাদার কথায়, সারা দুপুরে ঘুরে-ঘুরে পুরোনো ফেলে দেওয়া টিউব-লাইট সব বন্ধুরা মিলে জোগাড় করে এনেছি খুব সাবধানে ! তারপর, দাদার কথায় হাথে দস্তানা পরে আর চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে হামান্-দিস্তা দিয়ে সেগুলোকে মিহি করে সবাই মিলে একটু-একটু করে গুঁড়ো করেছি ! প্রায়, সারাদিন চলে গেছে ঐগুলো গুঁড়ো করতে !

তারপর, দাদার এনে দেওয়া আঠা ও সঙ্গে তুত মিশিয়ে ভালো করে আগুনে গরম করে রেখে দেওয়া হয়েছে ! ঠিক হলো যে রাত নটা থেকে দশটা পর্যন্ত ছাদে আটকানো দুটো বাঁশে আমরা পাঁচ বন্ধু – দাদার তত্ত্বাবধানে সেই প্রথম সুতোতে মাঞ্জা দেব ! আমার জন্য একটু অসুবিধা হলো – সময়টা ! কারণ, ঠিক ওই সময়ে বাড়ি থেকে নাও ছাড়তে পারে ! আবার, ঐদিকে এতে যোগদান করার লোভটাও সামলাতে পারছি না ! এমন একটা জিনিস না দেখার লোভটাও তো অনেকখানি !

বাড়িতে ফিরে মা কে জিজ্ঞাসা করতেই মা জানিয়ে দিলেন – “বাবাকে জিজ্ঞাসা করো ! তারপর, ওই হাত-পা কেটে কেলেঙ্কারি বাধাবে ! আমি বকা খাবো ! হবে না !”

এই কথা শুনে মনে-মনে ধরে নিলাম – “সব আশা শেষ ! আর হবে না !”

মায়ের ওপর খুব অভিমান করে প্রায় চোখে জল এনে বললাম – “এট্টু বললে কি হয়? আর, তাছাড়া আমি বড়ো হয়ে গেছি !”

মার আবার সেই একই উত্তর !

জানি কিছু হবে না – তাও যাই গিয়ে বলি ! কিন্তু, মনের কোনায় যেন একটা মিরাকেল ঘটনা তখনও খুঁজে চলেছে ! কিন্তু, এও জানি তা নিছকই আমার মনের ! হবার নয় !

কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম – “বাবু, আজ রাতে আমি একটু একঘন্টার জন্য বাইরে যেতে পারি ?”

বাবা জিজ্ঞাসা করলেন – “কেন ?”

মনে-মনে ভাবলাম – “হয়ে গেলো !”

বললাম – “কাল বিশ্বকর্মা পুজো ! আজ সারাদিন ধরে আমরা সবাই মিলে মাঞ্জার উপকরণ জোগাড় করে তৈরী করেছি ! সব কিছু সাবধানতা মেনেই ! ওই চারতলার দাদা সারাক্ষন দেখে গেছে, যাতে আমাদের কোনোভাবে কিছু কেটে না যায় ! রাতে ঠিক হয়েছে আমরা পাঁচজন মিলে আমাদের সুতোয় মাঞ্জা দেব !”

বাবা আরো জিজ্ঞাসা করলেন – “এই যে সেদিন তুই টাকা নিলি মাঞ্জা কিনবি বলে ? তার কি হলো ?”

আমি বললাম ওটাও আছে – “ওটা টেনে খেলার মাঞ্জা ! আর, এটা ছেড়ে খেলার !”

বাবা শুনে একটু আশ্চর্য হয়ে দেখে মাঞ্জার সব পরিমান জিজ্ঞাসা করতে থাকলেন ! আর, আমিও যতটা সম্ভব পরীক্ষার পড়ার মতো তার উত্তর দিতে থাকলাম !

আরও, অবাক হলাম বাবা দুজায়গায় আমার ভুলও ধরিয়ে দিলেন ! এবং, কি করলে ছেড়ে খেলার মাঞ্জা সুতো ভালো তৈরী হয়, সেটাও বলে দিলেন ! এইবারে, আমিও অবাক হয়ে চুপ করে তাকিয়ে আছি ! বুঝতে পারছি না ঠিক কি হচ্ছে আমার সামনে ! খানিকটা চারমূর্তির ভ্যাবল-কুমার হয়ে গেছি !

এরপর, বাবা কথা বলে আবার বই পড়তে থাকলেন ! আমি খানিকটা ঘোর কাটিয়ে বেরিয়ে এসে আবার জিজ্ঞাসা করলাম – “তাহলে কি করবো ?”

বাবা বললেন – “যাও ! তবে আমার দস্তানাটা পরে যাও ! আর, মুখ-চোখ সামলে !”

আমি এক লাফে উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরে মাকে চিৎকার করে বললাম – “মা ! বাবু, পারমিশন দিয়ে দিয়েছে !”

কথাটা মাও যেন বিশ্বাস করতে পারেনি ! চট করে রান্নাঘর থেকে এসে বাবাকে বললেন – “কিগো ? ওই কাঁচ দিয়ে কিসব করবে ! তুমি হাঁ করে দিচ্ছ ! তারপর, হাত-পা কেটে বসলে ?”

বাবা বললেন – “কিচ্ছু হবে না ! ওর মতো বয়সে আমি অনেক ঘুড়ি উড়িয়েছি মাঞ্জা দিয়ে ! না করলে কোনোদিন শিখবে না ! ওকে বলেছি কি কি দেখে করতে হবে !”

সেই মুহূর্তে আনন্দে চোখে জল চলে এসেছিলো ! মা যদিও বাবার এই প্রস্তাবটা পছন্দ না করলেও আর বাধা দেননি !

চতুর্থ পর্ব :

সেদিন রাতে তাড়াতাড়ি পড়াশোনা করে নটার মধ্যে বাবার দস্তানা পরে বেরিয়ে গেলাম ! ছাদে উঠে দেখি দাদা আর আমার দুই বন্ধু উঠে সবে আমাদের সুতোগুলো দুই বাঁশের মধ্যে লাগাচ্ছে ! ছাদের দুদিকে দুটো বাঁশ সব-সময় দেওয়ালে লাগানো থাকে ! ওখানে বিল্ডিঙের লোকজন দড়ি লাগিয়ে দিনের বেলায় কাপড়-জামা মেলে রেখে দিতো শুকোনোর জন্য ! রাতের বেলায়, কারোর সেই বাঁশ দরকার নেই ! কাজেই আমরা তার যথার্থ সৎব্যাবহার করবো !

ছাদে উঠে বাবার বলে দেওয়া টিপ্গুলো সবাইকে বলে দিলাম ! আর, কে বলেছে সেটাও বললাম ! শুনে, আমার মতো বাকি সবাইও বেশ তাজ্জব হয়ে গেলো ! কারণ, সবাই বাবাকে একজন বেশ রাশভারী মানুষ হিসাবে চেনে, যার কাছে অনেকেই পরামর্শের জন্য যায় ! কিন্তু, সে যে মাঞ্জার সঠিক পদ্ধতি বলে দেবে, সেটা হজম করতে বেশ অসুবিধাই হচ্ছিলো সবারই !

ঠিক নটা-দশ নাগাদ, আমরা মাঞ্জা দেওয়া শুরু করলাম ! যখন যার সুতো আসবে, তখন সে ফাইনাল টিপটা ধরবে ! আর, বাকিরা অন্য কাজগুলো করবে! আমি বাবার বলে দেওয়া টিপ্ অনুসরণ করলাম ! বিষয়টা বোঝা গেলো পরের দিন সকালে !

তবে, সেই মুহূর্তে ওই টিপ্ দেওয়াটা যে কি আনন্দের, তার কাছে হয়তো আজ নতুন কিছু কিনে আনার আনন্দও মাটি হয়ে যায় ! তার সঙ্গে, চারতলার দাদার গলায় কিশোর কুমারের একটার পর একটা গান ! সেটাই সেরা আনন্দ !

আমাদের গলা পেয়ে চারতলার কাকু-কাকিমারা উঠে এসে দেখে সবাই বেশ ভালোভাবে মজার ছলেই একটু সময় কাটিয়ে চলে গেলেন ! এ জিনিস তো আমি ভাবিনি ! বরং, ভেবেছিলাম লোকজন আওয়াজ পেয়ে উঠে এসে যদি দেখে, তাতে না আমাদেরকে বকাবকি করে – যেহেতু ওই বাঁশে সুতো লাগিয়ে মাঞ্জা দিচ্ছি ! কারণ, এই সুতো এখন বেশ রাত অব্দি থাকবে ! শুকোলে, তারপর আমরা যে যার নিজের লাটাইতে সুতো ভাগ করে গুটিয়ে নিয়ে যাবো !

প্রায়, রাত বারোটা অব্দি বেজে গেছে ! এবারে, আবার আমার চিন্তা শুরু হয়ে গেছে ! নিচ থেকে মা ডাকতে শুরু করেছে আমার ডাক নাম ধরে ! আমি বুঝতে পারছিনা কি করবো ! মাকে ছাদ থেকেই বললাম – “মা ! প্রায় শুকিয়ে এসেছে ! আর হয়তো আধঘন্টা লাগবে ! হয়ে গেলেই আমি চলে আসছি ! “

আর মনে-মনে ভাবছি – “এবারে, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ! এমনিতেই আসতে পারতাম না ! সেখানে আসার ছাড় দিয়েছে ! তার ওপর আবার দেরি করছি এতো বেশি !”

শেষ আধ ঘন্টার মধ্যে হয়ে গেলে সুতো গুটিয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকছি একটু ভয়েই ! দেখলাম মা শুয়ে পড়েছে ! বাবা এসে দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন – “শুকিয়েছে ভালো করে ? নাকি মায়ের ডাকার ভয়ে পালিয়ে এলি !”

আবার চমক ! আমি বললাম – “হাঁ ! শুকিয়েছে অনেকটাই !”

বাবা ভালো করে লাটাইটা দেখে রান্না ঘরে উনুনের চিমনির পাশে লাটাইটা বেশ কায়দা করে দিয়ে বললেন – “উনুনে এমনি কোনো আগুন নেই ! যেটুকু গরম আছে ! তাতে বাকি সুতোটা শুকিয়ে যাবে – যদি একটুও ভিজে থাকে তো ! যা ! এবারে শুয়ে পর ! কাল তো সকালে উঠতে হবে ?”

আবার আমি স্টাম্পড ! বুঝতে পারছি না কিভাবে নিজেকে প্রকাশ করবো !

সারারাত প্রায় ঘুম আসছে না ! প্রচন্ড উত্তেজিত ! কাল, কিছু একটা হবে !

পঞ্চম পর্ব :

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখি মা জলখাবার বানিয়ে দিয়ে গেলো ! তারপর, খেয়ে উঠে ভাবছি কখন বেরোবো, এমন সময় বাবা – ওঁর প্রিয় একটা সানগ্লাস চোখে পরিয়ে দিয়ে বললো – “এটা পরে খেলবি ! চোখে আলো লাগবেনা ! খেলতে কষ্ট হবে না ! কিন্তু, ঘুড়ি কাটলে পাগলের মতো ছুটে দৌড়াতে যাবে না ! কারণ, সেটা চারতলায় তোমরা আছো ! কথাটা মনে রেখো !”

আমি এক গাল হেঁসে – “ঠিক আছে !” – বলে বেরিয়ে গেলাম ! কারণ, আমি এমনিও ওরকম করি না !

ছাদে গিয়ে উঠে দেখি – আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সব থেকে এক্সপার্ট একজন এসে গেছে ! সে ঘুড়িটা বেড়েও ফেলেছে ! আর, এছাড়া আমাদের পাড়ায় কিছু কুচো-চিংড়ি বা জুনিয়র ছেলে-পুলে ছিল ! যারা বয়সে আমাদের থেকে ছোট হলেও, আমাদের সঙ্গে সব-সময় খেলা-ধুলো করতো ! সেইরকমই একজন আমার বন্ধুর লাটাইটা ধরে রইলো ! আর, আমার ঘুড়িটা ও দূর থেকে ধরে আমার কথায় উপরে ছাড়লো ! আমি সঙ্গে-সঙ্গে এক্সপার্টদের মতো একটু টান দিয়ে হাওয়ার সঙ্গে ওপরে তুলতে থাকলাম !

সেই মুহূর্তে আমি অবশ্য লোড-শেডিং মাঞ্জা ব্যবহার করছি ! অনেকেরই কৌতহল এই মাঞ্জাটার ওপর ! এই মাঞ্জা দিয়ে প্রায় গোটা চারেক ঘুড়ি টেনে কাটলাম ! সেই দেখে আমার বুকটা ক্রমশ ফুলে উঠছিলো ! কিন্তু, হঠাৎই পেছনের নতুন বিল্ডিং থেকে একজন বড়ো দাদা পুরো হাথের সামনে দিয়ে আমার ঘুড়িটা কেটে দিলো !

আমাদের বিল্ডিং থেকে সবাই বলে উঠলো – “আরে ! কিরে ? তোরা এতো বড়ো হয়ে এই বাচ্ছাটার হাথের থেকে কাটছিস ? একটা “ফেয়ার-প্লে” তো কর !

ওটার ফলে আমার কেনা মাঞ্জা প্রায় শেষ ! এক হাথও আর বাকি নেই ! নিচে ঘরে এলাম, আমাদের নিজেদের তৈরী মাঞ্জা আর লাটাই নিতে ! সঙ্গে কতগুলো ঘুরিও !

বাবাকে খুব আগ্রহ নিয়ে বললাম – আমি কটা ঘুড়ি কেটেছি, আর আমারটা কি অন্যায়ভাবে কেটেছে ! তাই, এখন ঘরের তৈরী মাঞ্জা নিয়ে যাচ্ছি – এইসব !

শরৎকাল প্রায় পরে গেছে ! ঝকঝকে নীল-আকাশে, সাদা-পেঁজা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে ! দারুন হাওয়া দিচ্ছে ! সব মিলিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর আদর্শ দিন !

তাই, ছাদে উঠে আবার এক কুচোকে বললাম একটু ঘুড়িটার হাত বাড়িয়ে দিতে ! ঘুড়ির সঙ্গে সবে লাটাইয়ের সুতো লাগাচ্ছি – এর মধ্যে দেখি বাবা একটা ধপধপে সাদা-পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে ছাদে চলে এসেছেন !

আমরা সবাই তো অবাক ! কারণ, সাধারণত বিল্ডিঙের কোনো মিটিং বা পিকনিক বা বিয়ে বাড়ি ছাড়া খুব একটা ছাদে উঠতে কেউই কখনো দেখেনি বাবাকে !

এসে আমায় বললেন – “তুই বার ঘুড়িটা !” কুচোকে বললেন – “তুই লাটাই ঠিক করে ধরতে পারবি তো ?”

ও অনেকটা আমার মতোই ঘোরে মাথা নেড়ে – “হাঁ” – জানিয়ে দিলো !

বাকিরা তখন নিজেদের ঘুড়ি ওড়ানো ছেড়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে ! গোটা ব্যাপারটায় আমি যতটা অবাক হয়ে গেছিলাম, ততটাই আনন্দ লাগছিলো এই ভেবে যে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রে আমরা তখন !

এরপর, আমি ঘুড়িটা একটু উপরে ছুড়ে দিতেই বাবা দেখি সুতোয় টান দিয়ে খেলিয়ে-খেলিয়ে হাওয়ার সাথে ওপরে নিমেষে তুলে দিলেন ! অথচ, আমি ছোটবেলা থেকে নিজের চোখে কখনো দেখিনি বাবাকে ঘুড়ি ওরাতে ! তাই যেন, নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না !

সব থেকে বড়ো কান্ডটা তারপর হলো ! পেছনের নতুন বিল্ডিং থেকে আবার হাথের কাছ দিয়ে কাটতে গেলে বাবা ঘুড়িটাকে অনেকটা দূরে অথচ নিচে নামিয়ে দিলেন ! সামনে আর কোনো বিল্ডিং না থাকায় কোথাও ফাঁসলো না ! আবার ঘুড়িটা আটকালো না, কেও কাটতেও পারলো না ! এরপর, পিছনের দাদা যখন আরেকটু বাড়িয়ে নিচ থেকে কাটার ব্যবস্থা করছে, ঠিক তার আগে বাবা সুতোটা বেশ খানিকটা গুটিয়ে নিয়ে মাঞ্জার ভাগটা অনেকটা নিচে নামিয়ে নিলেন ! তখন, আমাদের ঘুড়িটা উচ্চতা অনুযায়ী প্রায় পিছনের ঘুড়ির কাছাকাছি এসে গেছে ! সেটা ওরা দূরে থাকায় বুঝতে পারেনি !

আমরা কিন্তু বুঝে গেছি এখন আমরা ভালো জায়গায় চলে এসেছি ! এরপর, ওরা টেনে যেই খেলতে এসেছে, হাওয়ার জোরে বাবা দেখি সুতো ছাড়তে শুরু করেছেন ! আর, তার ফলটা পেলাম নিমেষের মধ্যে ! বাবারই বলে দেওয়া টিপের দৌলতে মাঞ্জাটা জবরদস্ত হওয়াতে নিমেষের মধ্যে ওরা উড়ে গেলো !

এবারে, আমাদের বিল্ডিং থেকে জোরে একটা শব্দের পুরস্কার ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হলো – “ভো…..কাটা !” সঙ্গে, চারতলার এক কাকু এও বলে উঠলেন – “আমরা স্পোর্টসম্যান-স্পিরিট নিয়ে খেলি রে ! তোদের মতো না !”

বাবা যদিও মুখে কোনো কথা বললেন না ! কিন্তু, চোখে-মুখে হয়তো ওঁর ছোটবেলার কথাই ফুটে উঠছিলো ! আর, কিছু না বলেও হয়তো অনেক কিছু বলে দিলেন !

আর, সেই দিনটা আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখে গেলাম ! তাই, আজও সেই দিনটা আমার কাছে ভীষণ স্পেশাল !

বিশেষ ঘোষণা :
  • সমস্ত ছবি আমার নিজের তোলা – এই ছবির সাথে গল্পের চরিত্রের কোনো মিল নেই ! নেহাৎ প্রচ্ছদের কারণে প্রতীকী হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে !
আমার গল্প কেমন লাগলো তা এখানে একটা ছোট্ট-কমেন্টস দিয়ে জানালে খুব ভালো লাগবে !

আশা করি আপনারা সবাই ভালো থাকবেন ও সুস্থ থাকবেন !

@কপিরাইট – সাত্যকি দে

Subscribe বোতাম এ ক্লিক করুন আপনার ইমেইল দিয়ে, ও আরো অনেক ছবির সাথে ঘুরতে যাওয়ার গল্প পড়ুন !